মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুন্দরবন: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি উলেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবেও এটি বিবেচিত। এখান থেকে সংগৃহীত হয় নানা কাজে ব্যবহার উপযোগী বনবৃক্ষ, আহরিত হয় প্রচুর পরিমাণ মধু, মোম ও মাছ। সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার অংশবিশেষ জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। পরস্পর সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে।আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বেও মূল সুন্দরবনের এলাকা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিমি। বর্তমানে সংকুচিত হয়ে প্রকৃত আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে।

সুন্দরবনের গাছপালার অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ ধরনের এবং এখানে রয়েছে বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ঘাস, পরগাছা এবং আরোহী উদ্ভিদসহ নানা ধরনের উদ্ভিদ। অধিকাংশই চিরসবুজ হওয়ার কারণে এদের সবার শারীরবৃত্তিক ও গঠনগত অভিযোজন কমবেশি একই রকম। অধিকাংশ বৃক্ষের আছে ঊর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল, যার সাহায্যে এরা শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। এ বনের প্রধান বৃক্ষপ্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। ১৯০৩ সালে ডি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ২৪৫ গণের অধীনে ৩৩৪টি উদ্ভিদপ্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন; এর মধ্যে ১৭টি ফার্নজাতীয়, ৮৭টি একবীজপত্রী এবং অবশিষ্ট ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী। প্রজাতিগুলির মধ্যে ৩৫টি শিমগোত্রীয়, ২৯টি তৃণজাতীয়, ১৯টি হোগলাজাতীয় এবং ১৮টি সিডজাতীয়। আজ পর্যন্ত জানা প্রায় ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদপ্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো, গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়। এদের অনেকেই বনের তলদেশ খালি না রেখে সাধারণত দলবদ্ধভাবে জন্মায়।

সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার লবণাক্ত পানির বনভূমিতে গেওয়া, গরান, কেওড়া, ওড়া, পশুর, ধুন্দুল, বাইন এবং অন্যান্য ঠেসমূলবাহী উদ্ভিদ প্রধান। হেন্দালও এ এলাকার অন্যতম প্রধান উদ্ভিদপ্রজাতি। বনের মধ্যভাগে ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্যমূলক বৃক্ষপ্রজাতির প্রাধান্য বেশি। খুলনা ও বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ এলাকা পরিমিত লবণাক্ত পানির বনে ঢাকা, আর এখানকার মুখ্য উদ্ভিদপ্রজাতি সুন্দরী। প্রায় সব খালের পাড়েই ঘনভাবে জন্মে গোলাপাতা। পশুর, হরিণঘাটা এবং বুড়িশ্বর নদী দিয়ে প্রবাহিত প্রচুর স্বাদুপানি লবণাক্ততা কিছুটা হ্রাস করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় সহনীয় স্বাদুপানির বন এলাকা গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। সুন্দরবনে স্পষ্টত কিছুটা উদ্ভিদ পর্যায় লক্ষ্য করা যায়, যেখানে নবগঠিত ভূমিতে কতক অগ্রগামী প্রজাতি, যেমন আরালি ও বুনো ধানের পরে জন্মায় বাইন, কেওড়া এবং খুলশী। দ্বিতীয় উদ্ভিদ পর্যায়ে আছে গরান, গেওয়া, তুনশা, সুন্দরী, পশুর, এবং ঝানা। টাইগার ফার্ন জন্মে লবণাক্ত ও কম লবণাক্ত এলাকায় প্রায় ভূমি ঘেঁষে। গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য বাঘ এসব ঝোপ ব্যবহার করে।

সুন্দরবনে নানা ধরনের প্রাণীর বাস। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গুরুত্বপূর্ণ আবাস এখানেই। অধিকন্তু এ বনভূমিতে আছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ।রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উলেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ এবং বন্য শূকর। হরিণ ও বন্য শূকর বাঘের প্রধান শিকার। বাঘসহ এখানকার আরও কতক প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। বাস্তুসংস্থানিক বৈচিত্র্য সুন্দরবনকে দান করেছে নানাবিধ পাখির এক অপরূপ আবাসস্থান। এখানে বসবাসকারী অধিকাংশ পাখিই স্থানীয় বা আবাসিক, প্রায় ৫০ প্রজাতি অনাবাসিক বা পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটিসহ অসংখ্য উপক‚লীয় পাখি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। সমুদ্র এবং বড় বড় নদীর উপক‚লভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাংচিল, জলকবুতর, টার্ন ইত্যাদি।চিল, ঈগল, শকুন ইত্যাদির প্রায় ২২ প্রজাতির প্রতিনিধি এখানে রয়েছে। এ বনে মাছরাঙা আছে ৯ প্রজাতির। পাখি সম্পদে উৎকর্ষ সুন্দরবনে কাঠঠোকরা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে বৌ, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট গায়ক পাখি।প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের কোন কোনটির দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৭ মিটার। ম্যানগ্রোভ পরিবেশে এক সময় এদের প্রচুর দেখা গেলেও এখন সেখানে এদের সংখ্যা মাত্র ২৫০ হবে বলে মনে করা হয়। গুইসাপসহ টিকটিকিজাতীয় সরীসৃপ, কচ্ছপ এবং সাপের প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক। সাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজগোখরা, রাসেলস ভাইপার, অজগর, ব্যান্ডেড ক্রেইট এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ।সুন্দরবন থেকে মাত্র ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বর্ণনা রয়েছে। সবুজ ব্যাঙ বেশি দেখা যায় চাঁদপাই এলাকায়। এ বন অঞ্চলের অন্যান্য উভচরের মধ্যে রয়েছে স্কিপার ফ্রগ, ক্রিকেট ফ্রগ, গেছো ব্যাঙ এবং সাধারণ কুনো ব্যাঙ।

সুন্দরবনের নদীনালা ও অন্যান্য জলাশয়গুলিতে বাস করে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ; এর মধ্যে একদিকে যেমন আছে পানির বিভিন্ন স্তরে বিচরণশীল মাছ, অপরদিকে আছে পানির তলদেশে বাস করে এমন কিছু মাছ প্রজাতি। অনেক মাছ ম্যানগ্রোভ পরিবেশের জলাশয়কে ব্যবহার করে তাদের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মাৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৮ প্রজাতির লবস্টার, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ৬ প্রজাতির ঝিনুক। চিংড়ির মধ্যে বাগদা চিংড়ি ও হরিণা চিংড়ি এবং কাঁকড়ার মধ্যে মাড ক্রাব বাণিজ্যিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্য সীমাহীন। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত মৌয়ালদের পেশা মধু সংগ্রহ করা। তারা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ফুলের মৌসুমে তিন চার মাস বন থেকে মধু সংগ্রহ করে। সুন্দরবনে মাকড়সার প্রাচুর্য রয়েছে। এখান থেকে ২২টি গোত্রের অধীনে প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাকড়সা তালিকাবদ্ধ হয়েছে।

সুন্দরবন বা সুন্দরবনের সংলগ্ন এলাকাতে খুব কম মানুষজনই স্থায়ীভাবে বসবাস করে। স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বাওয়ালি, মউয়াল এবং কাঠুরে। বনের ধার ঘেঁষে ৩-৫ মিটার উঁচুতে কাঠ বা বাঁশের মঞ্চ তৈরি করে তার উপর তারা ঘর বাঁধে। কতক লোক, বিশেষ করে বেদেরা নৌকায় যাযাবর জীবন কাটায়। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বহুলাংশে প্রাকৃতিক পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। বনের অধিকাংশ এলাকায় আহরিত-বৃক্ষ প্রতিস্থাপনের জন্য প্রচুর বীজ সংগৃহীত হয়। দেখা গিয়েছে প্রতিবছর হেক্টর প্রতি গড়ে প্রায় ২৭,৭৫০ চারা উৎপন্ন হয়, যদিও বনভূমির এলাকাভেদে এর ঘনত্বে তারতম্য হয়। সুন্দরী, গেওয়া এবং অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতি একত্রে যথাক্রমে প্রায় ২৪, ৫৪ এবং ২২ শতাংশ চারা উৎপন্ন করে।বন এলাকার লবণাক্ততা পুনরুৎপাদন ঘনত্বকে প্রভাবিত করে, বেশি লবণাক্ততা ঘনত্ব কমায়। সরবরাহকৃত চারার পরিমাণ বিভিন্ন বছরে কমবেশি হয়, তবে এ ক্ষেত্রে লবণাক্ততার প্রভাব সামান্যই। সুন্দরবনের লবণসৃমদ্ধ তিনটি এলাকায় চারা উৎপাদনের মাত্রার বৈষম্য লক্ষণীয়। সুন্দরী, গেওয়া এবং অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতির চারা উৎপাদনের তারতম্য বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন পরিমাপের হয়।

প্রমোদ ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের এক আকর্ষণীয় স্থান সুন্দরবন। এখানকার কটকা, হিরণ পয়েন্ট (সাধারণভাবে নীলকমল নামে পরিচিত), দুবলার চর এবং টাইগার পয়েন্ট (কচিখালী)-এ প্রতিবছর পর্যটকদের প্রচুর সমাগম ঘটে। কটকার অনবদ্য প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং বন্যপ্রাণী ভ্রমণকারীদের জন্য অতি আকর্ষণীয়। এখানে বনবিভাগ পরিচালিত একটি ডাকবাংলো এবং একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। হিরণ পয়েন্টেও আছে পর্যটকদের জন্য অতিথি ভবন এবং একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দুবলার চর একটি ছোট দ্বীপ, এর সমুদ্র সৈকত অতি মনোরম। এর অন্য আরেকটি আকর্ষণ মাছ ধরার কর্মকান্ড, যা প্রতিবছর মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে। এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে আসে শত শত জেলে। এখানে তারা মাছ ধরে এবং রৌদ্রোজ্জ্বল বেলাভূমিতে তা শুকায়। মধু সংগ্রাহক মউয়ালরা সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বনের গভীরে ঢুকে মৌচাক খোঁজে।

সুন্দরবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব এর সংরক্ষণমূলক ভূমিকা। এ বন উপকূলভাগের ভূমিক্ষয় রোধ করে, উপকূলীয় এলাকা পুনরুদ্ধার করে এবং নদীবাহিত পলি স্তরীভূত করে। এর মোহনা অঞ্চল বহু ধরনের মাছের প্রজনন কেন্দ্র। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। উদ্ভিদনির্ভর শিল্প-কারখানার মধ্যে রয়েছে দিয়াশলাই ও নৌকা তৈরির কারখানা।এ বনভূমি জ্বালানি, ট্যানিন, ঘরের ছাউনি তৈরির উপকরণ, কাঠজাত দ্রব্য, ভেষজ উদ্ভিদ এবং পশুখাদ্যের অন্যতম প্রধান উৎস ও যোগানদার। দেশের অধিকাংশ মধু ও মোম সংগৃহীত হয় সুন্দরবন থেকেই।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন