আশরাফ জামান
ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের সিরাজাম মুনীরা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে ঢাকায়। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে কলকাতা থেকে। প্রকাশ করেন কবি বেনজীর আহমদ। এ কাব্যটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন।
ইসলামী রেনেসাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম মহানবীর জীবনী নিয়ে একটি কাব্য রচনা করতে চেয়েছিলেন তারই বাস্তব রূপায়ন হলো ‘মরু ভাস্কর’ নামক কাব্যগ্রন্থ। অনুরূপ কবি ফররুখ আহমদও একটি কাব্য রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রসঙ্গে সুসাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন : ‘কলকাতায়’ থাকতে ফররুখ মহানবীর জীবনী নিয়ে কবিতা লেখার কথা আমাকে বলেছিল। মনে আছে সে একটি পরিকল্পনার কথা বলেছিল।
সেটি নি¤œরূপ : ‘মহানবীর জন্ম যখন হলো তখন একই সময়ে ইরানের অগ্নিপূজকদের শাশ্বত অগ্নিনির্বাপিত হয়েছিল এবং জামসিদের পানপাত্র ভেঙে গিয়েছিল। ফেরেশতাদের মধ্যে উল্লাস জেগেছিল যে, একজন মহান পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। এ সমস্ত ঘটনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিছেদে সে একটি বৃহৎ কবিতা লিখবে এ পরিকল্পনার কথা সে আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু এ পরিকল্পনা সে ঠিক রাখতে পারেনি। নতুন পরিকল্পনায় আমরা দেখি যে, ‘সিরাজাম মুনিরা’ নাম কবিতার সঙ্গে খোলাফায়ে রাশেদীনদের নিয়েও তিনি কয়েকটি কবিতা এ গ্রন্থে সংযোজিত করেছেন এবং কাব্যগ্রন্থের শেষে আরো অনেকগুলো কবিতা যোগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে শহীদে কারবালা, মন, আজ, খাজা, নকসবন্দ, মোজাদ্দিদে আল ফেসানি, মৃত্যু সংকট, অভিযাত্রীকের প্রার্থনা, মুক্তধারা এবং ইশারা। ভাবের দিক থেকে মিল আছে ভেবে ফররুখ এ কবিতাগুলো এ গ্রন্থের সঙ্গে যোগ করেছিলেন’।
ফররুখ আহমেদ কলেজে পাঠকালীন বামপন্থি চিন্তাভাবনা ও বামপন্থি কবিদের কবিতা তাকে প্রভাবিত করে। এ সময়ে তিনি তার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মওলানা আবদুল খালেকের উদার ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তিত হন।
কবিকন্যা সাইয়েদা ইয়াসমিন বানু লিখেছেন : ‘প্রথম জীবনে আব্বা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মানব দরদি কমরেড এম এন রায়ের শিষ্য। যিনি আটটি ভাষায় প-িত ছিলেন। আব্বার জীবনে এক অচিন্তনীয় পরিবর্তনের মূলে যে মহান আউলিয়ার দোয়া ছিল তিনি হচ্ছেন আব্বার পীর অধ্যাপক আবদুল খালেক তৎকালীন যুগে ইংরেজি এবং আরবিতে ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট)। বহু বিতর্কের মাধ্যমে আব্বাকে পরাস্ত করে সেদিন তিনি আব্বাকে বুঝিয়ে ছিলেন যে, ইসলামই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যেখানে মানুষের জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান রয়েছে।’
কবির ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে যে কবিতাগুলো রয়েছে তার নাম ‘সিরাজাম মুনীরা’ মুহম্মদ মুস্তফা, হযরত আবুবকর সিদ্দিক, উমর দরাজ দিল, ওসমান গনি, আলী হায়দার, শহীদে কারবাল, মন, আজ সংগ্রাম, এই সংগ্রাম, প্রেমপন্থী, অশ্রুবিন্দু, গাওসুলআজম, সুলতামুল হিন্দ, খাজা নকসবন্দ, মুজাদ্দিদে আলফেসানী, মৃত্যু সংকট, অভিযাত্রীদের প্রার্থনা, মুক্তধারা ও পিপাসা।
দুই.
‘সিরাজাম মুনীরা’র আভিধানিক অর্থ হলো আলোর পথ বা আলোকিত সূর্য। গ্রন্থটিতে যাদেরকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে তারা পৃথিবীর তৎকালীন ও অনাগত মানুষের জন্য আলোর পথ দেখিয়েছেন অথবা বলা যায় তারা সেই আলোকিত সূর্য যাদের আলোকে সভ্যতা, মানবতা ও মানুষের সঠিক পথে চলার পথ দেখে চলবে পৃথিবীর মানুষ তৎকালীন সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আর সে পথে প্রধান পথ নির্দেশক হলেন আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
সিরাজাম মুনীরা কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘সিরাজাম মুনীরা মোহাম্মদ মুস্তফা’।
এখানে কবি মহানবী (সা.) পৃথিবীতে মা আমেনার কোলে যখন জন্মগ্রহণ করেন সে অবস্থায় প্রকৃতির মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো তার মনোজ্ঞ বর্ণনা করেছেন।
কে আসে কে আসে সাড়া পড়ে যায়
কে আসে কে আসে নতুন সাড়া
জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ জাগে শতাব্দী ঘুমেরপাড়া।
হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আনো প্রিয় আবহায়াত
জানি ‘সিরাজাম মুনীরা’ তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত,
মহানবী (সা.)-এর পৃথিবীর বুকে আগমনে যেভাবে শান্তির দুয়ার খুলে দিলো প্রকৃতি তার উপমা তুলে ধরেছেন কবি :
তুমি না আসিলে মধুভা-ার ধরায় কখনো হত না লুট,
তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতো না তার পত্রপুঠ,
... ... ...
হেরাপর্বতের গুহায় আল্লাহর ধ্যান করতে করতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) একদিন নিয়ে এলেন মহানবীর কাছে কোরআনের অমর বাণী। তার অমীয় বাণী উচ্চারণ করেছেন কবি। তার ভাষায় :
প্রবল বাহুতে টেনে নিয়ে ঐ বিরাট নিখিল ভরানো দিল,
বলে, পাঠ করো ফুকারে বিশাল দীপ্ত বক্ষ জীবরাইল।
... ... ...
সত্য নবীর আগমনেকে স্বাগত জানালো না মক্কার কাফের কুরায়িশ দল। যিনি পরম ¯্রষ্টার আহ্বানে সাত আসমানে গিয়ে তাঁর বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসে শান্তির অমিও বাণী প্রচার করলেন তাতেও তাদের দিল নরম হলো না। দূর মদিনার দরদি মানুষ তাঁর জন্য ভালোবাসার হাত বাড়ালো। কবি লিখেছেন :
সেদিন পূর্ণ মাটির মানুষ আনলে যে দান পূর্ণতার
আরব ঊষার নিখিল চিত্তে আজোও সে জাগায় গুলে আনার
মক্কার মরু নিল না তোমার প্রাণ রসে ভরা আবহায়াত
দূর ওয়েসিস পারে, মদিনার দরদি আকাশ বাড়ালো হাত,
নিজ বংশ, গোত্র ও আপনজন যাকে হত্যা করার জন্য সদা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাকে নবী বলে স্বীকার করেনি। তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য মহানবী (সা.) শেষ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার নির্দেশে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই শেষ নয়। ইসলামের প্রচার ও প্রসারতা তারা সহ্য করতে পারেনি। বদর, উহুদ যুদ্ধ তারা চাপিয়ে দিয়েছে শান্তিকামী মানুষটির ওপর।
আলোচ্য কবিতায় কবি হেরাগুহায় জিবরাইলের নিয়ে আসা আল্লাহর বাণীর ঘটনা থেকে মহানবীর (সা.) জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অতি সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। নরপিশাচ আবু জেহেলের শয়তানি, বদর উহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ, বেলালের দিকদিগন্ত বিস্তৃত আজানের কথা কবিতাটিতে তুলে ধরেছেন। যার পরশ পাথরে ছোঁয়া লেগে আবুবকর, ওমর, উসমান, আলী হয়ে উঠেছিলেন মানবতার মহান পুরুষ। কবির ভাষায় :
গলেছে পাহাড়, জ্বলেছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তোমার সাথে,
তোমার পথের যাত্রীরা কভু থামেনি চরম ব্যর্থতাতে
তাই সিদ্দিক পেয়েছে বক্ষে অসম সত্য সিদ্ধু দোল
তাই উমরে পাতার ডেরায় নিখিল জনেরও কলরোল
... ... ...
তিন.
মহানবী (সা.) ও চার খলিফাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি ফররুখ আহমদ।
মহান আল্লাহর বন্ধু মহানবী (সা.)-এর প্রিয় বন্ধু ছিলেন হযরত আবুবক্কর। যিনি মহানবী (সা.)-এর বিপদাপদ, সুখ-দুঃখ সকল ব্যাপারে ছায়ার মতো থাকতেন। বেহেস্তে যিনি থাকবেন রাসূল (সা.) এর পাশেই।
মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মদিনা যাত্রাকালে ‘সওর’ পর্বতে আত্মগোপন করলেন। এ সময় আবু বকরের জানুতে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
এক সময় বিষাক্ত গর্তের ছিদ্রপথে খলিফাকে দংশন করছিল কিন্তু প্রিয় নবীর ঘুম ভেঙে যাবে বলে তিনি নড়াচড়া করলেন না। বিষ দংশনে নিজে কষ্ট পেয়েও কিছু বললেন না। কবিতা অংশে কবি লিখেছেন :
দরদির বুকে প্রেম সমুদ্র বিরাট ¯েœহের সেকি পাহার,
নিল সে তনুতে সাপের ছোবল, নিল সে আঘাত অত্যাচার,
সেই সমব্যথী হেসে নেয় দেহে বিষদংশন বিষের চুম
তার বিশ্বাসী কোলে বিশ্রান্ত নবীজীর যেন ভাঙে না ঘুম।
হযরত আবুবকরের কাছে কবি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করছেন।
নিজ সত্তার পরিচয় তুমি জেনেছো কি নিভৃতে
তাই কি পেয়েছো নিজের চিত্তে অমনি বিলায়ে দিতে?
তাই কি মাটিতে মিশায়েছো অহমিকা?
তাই কি পেয়েছো ওই দুর্লভ মানুষের জয়টিকা?
হযরত আবু বকরের চরিত্র মাহাত্ম্য ছোট্ট একটি ঘটনা কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। ইসলামের দাওয়াত প্রচারের ব্যাপারে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, মানবতার সেবায় তার নিষ্ঠা, আল্লাহতায়ালা ও রাসূলের জন্য সর্বত্যাগী দৃঢ় ঈমানের অধিকারী মানবতার খলিফার জীবন চিত্র সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন কবি।
‘উমর দরাজ দিল’ শুরুতেই হযরত উমরের মানবতার রূপ তুলে ধরেছেন। অর্ধজাহানের খলিফা হয়েও যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন তার কর্মকা-ের জন্য।
দেখি সে চলেছে মরু মুসাফির কোথায় কে জানে
পিঠে বোঝা নিয়ে মৃত বিয়াবান ছাড়ায়ে কী টানে।
আরেক জায়গায় কবি লিখেছেনÑ
চলেছেসে দূরে ভৃত্যের সাথে মরু পথে,
চলেছেসে দূরে ভৃত্যের সাথে মরু পথে,
... ... ...
মানবতার কবি ফররুখ আহমদ সেই উমরের আগমনের স্বপ্ন দেখেছেন। এ দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ সমাজে সুখ-শান্তিতে ভরে দিতে পারে সেই উমর। কবি লিখেছেন :
আজকে উমর পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ,
... ... ...
কবিতাটি পড়তে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি মনে পড়ে। মহানবী (সা.) বলেছেন, আমার পরে যদি কেউ নবী হতো তবে হতো ‘উমর’।
ফররুখ আহমেদ লিখেছেন :
বন্ধু তোমার দারাজ হস্তে শিলাদৃঢ় যে আইন,
তার সম্মুখে সমান কাতারে খলিফা ও মিসকিন,
সূর্য প্রখর ন্যায় রশ্মিতে নাই তিল অন্যায়
সকলে সমান নবীজীর দেওয়া সে বিধান বন্যায়।
কবি তার ওসমান গনি কবিতায় ইসলাম জাহানের তৃতীয় খলিফা ওসমানের চরিত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। মহানবী (সা.)-এর জামাতা ওসমান আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার সমস্ত সম্পদ ইসলামের জন্য, গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য অকাতরে ব্যয় করেছেন। কবি লিখেছেন :
সত্যের পতাকা দেখ ওড়ে নভে বিপুল সম্মানে
শাহী বালাখানা কার মুক্ত হল অকৃপণ দানে?
ওগো শ্রেষ্ঠ ধনী
সে তোমারি!
ওসমান গনি!!
ওসমান (রা.) খিলাফতকালে ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সম্পন্ন করলেন তা হলো পবিত্র কোরআন সংকলন করা। অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এ কাজটি তার দায়িত্বে সুসম্পন্ন করেন। দানবীর ওসমানের দানশীলতা সম্পর্কে কবি লিখেছেন :
যার অফুরন্ত দানে জনপদে বেড়েছে সুষমা
জীবনের শেষে কড়ি প্রয়োজনে রাখো যে জমা,
... ... ...
মহানবীর প্রিয় জামাতা ও চাচা আবু তালিবের পুত্র হযরত আলী ইসলাম জাহানে জ্ঞানী ও বীর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। কবি তার আলী হায়দর নামক কবিতার শুরুতেই সে চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে :
পাহাড়ে পাহাড়ে তাহার গর্জন জাগে মরু প্রান্তর।
আলী হায়দর আলী হায়দর আসে আলী হায়দর।
... ... ...
মহানবী (সা.) বলেছেন, আমি হলাম জ্ঞানের ঘর আর আলী হলো সে গৃহের দরজা। কবি তার কবিতাংশে লিখেছেন :
... ... ...
শামাদানে জ্বলে প্রেমের শিখায় বেদনায় অবগাহি
কোটি মুসলিম পেয়েছে ফিরিয়া চিত্তের বাদশাহী!
চার.
কবি শহীদে কারবালা নামে একটি কবিতা এ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেনÑ ‘মহররম’ নামক কবিতা এ জাতীয়। মহানবী (সা.) প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেনের ওপর এজিদ বাহিনীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কবিতাটি রচনা করেছেন। এ যুদ্ধ জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। স্বৈরাচার এজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেনের স্বল্পসংখ্যক অনুসারীদের প্রতিবাদ। বীরসৈনিক হযরত আলীর পুত্র হোসেন আত্মসমর্পণ করতে পারেন না কাপুরুষের মতো। কবি লিখেছেন :
হোক দুশমন অগণন তবু হে সেনানী। আজ দাও হুকুম
মৃত্যু সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মোরা ভাংবো ক্লান্ত প্রাণের ঘুম।
... ... ...
এতে কবির মন, আজ সংগ্রাম, এই সংগ্রাম, প্রেমপন্থী, অশ্রুবিন্দু, গাওসুল আজম, সুলতানুল হিন্দ, খানা নকশবন্দ, মুজাদ্দিদে আলফেসানী, মৃত্যু সংকট, অভি যাত্রিকের প্রার্থনা, মুক্তধারা ও ইশারা নামে কয়েকটি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এর মধ্যে গাওসুল আজম, সুলতানুল হিন্দ, খাজা নকশ বন্দ ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী নামক কবিতাগুলো মহানবী (সা.) ও তার খোলাফায়ে রাশেদীনের ওপর লেখা কবিতাগুলো একটু ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে হয়।
পাঁচ.
মোজাদ্দিদে আলফেসানী স¤্রাট আকবরের মনোনীত দ্বীন-এলাহী অস্বীকার করেছিলেন। বাদশাহের দরবারে সেজদা প্রথার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। পরিণামে জাহাঙ্গীরের হাতে তাকে কারাগরে নিগৃহ হতে হলো। কিন্তু মেনে নেননি বাদশাহের অবৈধ প্রথা অবৈধ ধর্ম।
কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি লিখেছেন এ সময় (পঁয়তাল্লিশের মাঝামাঝি) ফররুখ ভাই দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছিলেন। তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তাই তখন ভেঙেচুরে নতুন রূপ নিতে চলেছে । ... যিনি ফররুখ ভাইয়ের এই কম ভার্শনের মুখ্য পুরুষ সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি মাওলানা আব্দুল খালেক ঘটনা চক্রে আমাদের টেইলর হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। ... তিনি অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন।
কবি ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যটি উৎসর্গ করেন মাওলানা আবদুল খালেককে ’’।
ফররুখ গবেষক ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যয় লিখেছেন, ‘সিরাজাম মুনীরা’ আদর্শ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ কবিচিত্তে আকাক্সক্ষার কাব্যিক প্রকাশের চেয়ে মনোগত আদর্শটির ব্যাখ্যাও প্রচারণায় বেশি উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। এতে কবি কাব্যব্রত যে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না’।
ফররুখ গবেষক মুহাম্মদ মতিউর রহমান ‘সিরাজাম মুনীরা’ সম্পর্কে লিখেছেন “ব্যক্তিগত জীবনে কাব্য ভাবনার ক্ষেত্রে তেমনি ফররুখ আহমদ ইসলামী আদর্শের নিষ্ঠাবান অনুসারী ছিলেন। কিন্তু আদর্শ প্রচারের প্রয়াস তার কাব্যকলাকে কখনো ব্যাহত করেনি। বক্তব্যকে অক্ষত রেখে কাব্যকলার প্রতি সম্পূর্ণ নিষ্ঠাবান বান থাকা অতিশয় দুরূহ সন্দেহ নেই। কিন্তু ফররুখ আহমদ অসাধারণ দক্ষতার সাথে অনায়াসে সেই দুরূহ কাজটি আশ্চর্য কুশলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন।’’
কবি ইসলামকে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করতেন। তাই তার অধিকাংশ রচনার মধ্যে সে আদর্শের পরশ দেখতে পাই।সাত সাগরের মাঝি থেকে তা শুরু হয়েছে।
ফররুখ আহমদের সিরাজাম মুনীরা বাংলা সাহিত্যের একটি অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। আধুনিক কবিদের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা, কবি নজরুল ইসলাম, শাহাদৎ হোসেনের রচনার মতোই ফররুখ আহমেদের এ কবিতা অসামান্য ও কৃতিত্বপূর্ণ। প্রতিকূল পরিবেশ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও শত রকমের বাধার মুখেও তিনি ছিলেন সিন্দাবাদ নাবিকের মতো কোনো বাধা তাকে কর্তব্য কর্মে বাধা দিতে পারেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন