শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাটে ফিরছে না সুদিন

পাটপণ্যে ভারতের চাপিয়ে দেয়া ‘অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক’ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ বাণিজ্যিক কূটনীতিতে চরম ব্যর্থতা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০১ এএম

মসলিন কাপড়ের মতোই এক সময় বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছিল বাংলাদেশের পাটের। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পাট উৎপাদন হতো তার এক তৃতীয়াংশ হতো বাংলাদেশে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাটকল ‘আদমজী জুট মিল’ ছিল বাংলাদেশে। পাটকে বলা হতো ‘সোনালী আঁশ’। বর্তমানের তৈরি পোশাক রফতানি আর প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মতোই কাঁচা পাট ও পাটপণ্য বিক্রি করে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো। অথচ নেতৃত্বে ব্যর্থতা, ভারতের ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র উপর অধিক নির্ভরশীলতায় বন্ধ হয়ে গেছে আদমজী পাটকল।

তবে দীর্ঘদিন পর পাটের দাম বাড়ায় কৃষকরা চাষও বাড়িয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি পাট নিয়ে কৃষকদের সেই অনিশ্চয়তা দূর করার বার্তা দিয়েছেন ঢাকায় কর্মরত সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত ইসসা ইউসেফ ইসসা আল দুহাআলান। তিনি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)’র বন্ধ মিলগুলো চালু করে পাটপণ্য উৎপাদনে সউদী আরবের বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। সউদী আরবের বিনিয়োগে আগ্রহ কিছুটা হলেও পাট শিল্পে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু এখনো ভারতের বাজারে পাটপণ্যের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক সমস্যার সমাধান না মেলায় বিপাকে পাট চাষিরা। চার বছর ধরে এক দফতর আরেক দফতরের উপর দায় চাপিয়ে সময় ক্ষেপন করছে। ২০১৭ সালে ভারতের আরোপ করা এ সিদ্ধান্ত ঠেকাতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কূটনীতি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মত ব্যবসায়ীদের। কোনো দেশের বিরুদ্ধে ৩ বছরের বেশি অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা না গেলেও ভারতের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের মেয়াদ ৪ বছর পার হয়ে গেছে। আর পাট মন্ত্রণালয় ‘দেখছি-দেখব, চেষ্টা চলছে’ এসব বলে বার বার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।

উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে ভারতের বাজারে পাটজাত পণ্য রফতানি করছে বাংলাদেশ এমন অভিযোগে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত। বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য বিশেষ করে বস্তা বা পাটের ব্যাগের বড় বাজার ছিল প্রতিবেশি এ দেশটি। রফতানিতে এ সঙ্কটের ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সমাধান হয়নি এখনও।

অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বিভিন্ন সময়ে ভারত পাটজাত পণ্যের ওপর এন্টিডাম্পিং শুল্ক (অতিরিক্ত শুল্ক) আরোপ করেছে। এমনকি ভারতের পাটের বীজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলেছেন। একই সঙ্গে পাটজাত পণ্যের ওপর ভারতের এন্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ বাংলাদেশের রফতানি মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন টিপু মুনশী।

ফরিদপুরের একজন কৃষক আব্দুর রশীদ গত বছর পর্যন্ত যে জমিতে ধান চাষ করেছেন, এই বছর সেখানে পাট লাগিয়েছিলেন। জুলাই মাসে সেই পাট তোলার পর প্রতি মণ বিক্রি করেছেন তিন হাজার ২০০ টাকা করে।
গত বছর পাট বিক্রি করে অনেকে লাভ করেছে দেখে এইবার আমিও লাগাইছি। দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম, বিক্রি করে ভালো লাভ হইছে। অনেক বছর পর আবার আমরার জমিতে পাট চাষ হইল বলে উল্লেখ করেন আব্দুর রশীদ।

বাংলাদেশের যত জমিতে পাট চাষ হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায়। তবে মন্দার কারণে কৃষকরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু গত বছর থেকে ভালো দাম পাওয়ার কারণে আবার পাটের চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই বছর সাড়ে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে কম-বেশি ৯০ লাখ বেল (১৮২ কেজিতে এক বেল)। প্রতি বিঘায় গড়ে নয় মণ পাট চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ স্থানে প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকার ওপরে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৭ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছিল। সেই বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ১৫ দশমিক ২৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে এই বছর উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন।

পাট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, অ্যান্টি ডাম্পিংয়ের এ অন্যায় সুযোগের মেয়াদ বাড়াতে আবারও তৎপরতা শুরু করেছে প্রতিবেশি দেশটি। বাংলাদেশি রফতানিকারক ও মিল মালিকদের কাছে আবারও চাওয়া হচ্ছে সংবেদনশীল তথ্য। আর তাই কৃষকদের পাট চাষে আগ্রহ থাকলেও রফতানি জটিলতায় এই খাতে সুদিন ফিরছে না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বাজারে পাটপণ্য রফতানির সঙ্কট সমাধানে সরকারের এক দফতর আরেক দফতরের ওপর কেবল দায়ই চাপিয়েছে।

বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ মজুমদার বলেন, কী কারণে আমরা ১০০ ডলারের জিনিস ৮০ ডলারে বিক্রি করব? নেপালের সঙ্গে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব হলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পারবেন না কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ সম্পর্কিত তথ্য ঠিকমতো দেয়া হয়নি। একই সঙ্গে সোনালী আঁশ পাটের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে পাট নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। তিনি একবাধিবার বলেছেন, পাট নিয়ে যারা হতাশ, সেই হতাশ পার্টির সঙ্গে তিনি নেই। পাট নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী তিনি। যে পণ্যটির কোনো অংশ ফেলনা নয়, সে পণ্যে লোকসান হয় কেমন করে? প্রধানমন্ত্রী এটাকে কীভাবে লাভজনক করা যায় সে পথ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অ্যান্টি ডাম্পিং ইস্যুটি নিষ্পত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও-তে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা করেনি বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে প্রশাসন।
বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফাইড প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক রাশেদুল করীম মুন্না ইনকিলাবকে বলেন, ভারতের বাজারে পাটপণ্যের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক সমস্যা নিয়ে আমরা কোনও শক্ত ভূমিকা দেখতে পাইনি। যৌক্তিক এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আমাদের উচিত ছিল ডব্লিউটিও সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মন্ত্রণালয় এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি।

সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফেরাতে নানা প্রচারণা থাকলেও রফতানি বাধা দূর করতে কার্যত কোনো পদক্ষেপই নেয়নি পাটমন্ত্রণালয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান জানান, শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গেও আলোচনা করছে। এটা এখন আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন