ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ফুলপুরের একই পরিবারের ৪ জনের নামাজে জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বার বার মূর্চা যাচ্ছে নিহত ফজলুল হকের বাবা-মা ও বোন। নিহতদের লাশ দাফন-কাফনের জন্য ফুলপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার হাটপাগলা গ্রামের ফজলুল হক আজমুল (৩২) তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৫), মেয়ে আজমিনা (৮) ও ছেলে আব্দুল্লাহকে (৬) নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। এ সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের চেলেরঘাটে পেরোয়া শেরপুরগামী বাস দাঁড়িয়ে থাকা পাথরভর্তি একটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ফাতেমার কোলে থাকা আব্দুল্লাহ ছিটকে পড়ে গেলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পড়ে যান মহাসড়কে। পাশের সিটে থাকা বাবা আজমুলও তাঁর কোলে থাকা আজমিনাকে নিয়ে পড়ে যান রাস্তায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের। এই দুর্ঘটনায় মোট ৭ জন মারা যায়। এর মাঝে ৪ জনই একই পরিবারের।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকায় ভাড়া বাসায় সপরিবারে থাকতেন ফজলুল হক। সেখানে আচারের ব্যবসা করতেন তিনি। ব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ফজলুল হক আজমুলের সাথে মা-বাবা, ভাই-বোনদের দেখা নেই। তাদের সঙ্গে দেখা করতে ও ছেলে আব্দুল্লাহর (৬) খৎনা করিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন আশা নিয়ে শনিবার ফুলপুরে গ্রামের বাড়িতে আসছিলেন স্ত্রী, দুই সন্তান ও চাচাকে নিয়ে। তারা বাড়িতে আসছে, সবার সাথে দেখা হবে এই অপেক্ষাতেই ছিলেন পরিবারের লোকজন। অবশেষে আসলেন তবে জীবিত না, লাশ হয়ে। তাদের মৃত্যু সংবাদ পৌছা মাত্রই শোকের ছায়া নেমে আসে পুরু এলাকায। শনিবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে মা-বাবা ও দুই সন্তানের লাশ হাটপাগলা গ্রামে পৌছার সাথে সাথে শত শত লোক ভিড় জমান এক নজর দেখার জন্য। তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। নিহত ফজলুল হক আজমুলের বৃদ্ধ বাবা কমর উদ্দিন চানু মন্ডল, বৃদ্ধা মা ছখিনা খাতুন, বোন শারমিন ও লাকিসহ পরিবারের লোকজনের চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে যায়।পরিবারের চারজনকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তারা। কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন কেউ কেউ। এসময় এলাকাবাসীকে তাদের সেবা ও শান্তনা দিতে দেখা যায়। পরিবারের লোকজনের কান্না দেখে উপস্থিত লোকজনের চোঁখেও পানি চলে আসে। অনেককে কাঁদতে দেখা যায়। রবিবার সকাল সাড়ে ৯ টায় একই পরিবারের ৪ জনের নামাজে জানাযা শেষে হাটপাগলা গ্রামেই তাদের দাফন সম্পন্ন হয়। একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা এলাকাবাসীসহ পরিবারের লোকজন।
নিহত ফজলুল হক আজমুলের বোন লাকি আক্তার দিশেহারা হয়ে বারবার বলছিলেন, আমারে থুইয়া (রেখে) কই গেলা ও ভাই গো, ও ভাবি গো। এই মনেরে কী দিয়া বুঝামু গো আল্লাহ। চারজন মিইল্যা একলগে কই গেল গা।আমার ভাইয়ের ঘরে আলো জ্বালাবে কে? সব শেষ হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের কোনো স্মৃতি রইলো না। হে আল্লাহ এ কেমন তোমার বিচার? ভাইয়ের কোনো অস্তিত্বও রেখে গেলে না।’
পরিবারের চারজন মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ফজলুল হকের চাচা রফিক মন্ডল বলেন, আমারও আজ বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তাদের সঙ্গে বাসের পেছনের দিকে ছিলাম আমিও। তবে ভালুকা আসার পর সামনে একজন নেমে গেলে আমি সামনে চলে যাই। আর তাতেই প্রাণেই বেঁচে যাই আমি। আমি এখন থানায় অপেক্ষা করছি ভাতিজার পরিবারের লাশ নেয়ার জন্য।
তিনি আরও জানান, ভাতিজা ফজলুর বড় শখ ছিল, গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছেলের খৎনা করিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন। এটা আর হয়ে উঠলো না। মনের দুঃখ রয়েই গেলো।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু একটা মর্মান্তিক ঘটনা। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের লাশ দাফন কাফনের জন্য প্রতিজনকে ২০ হাজার টাকা করে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন