শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক

প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর দু’দেশের বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ সফর ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা সুউচ্চ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দু’বন্ধুপ্রতীম দেশ তাদের সম্পর্ককে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই দেশ সহযোগিতার নিবিড় সমন্বিত অংশীদারিত্বকে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, চীন সহযোগিতার নিবিড় সমন্বিত অংশীদারিত্বকে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে নিয়ে যেতে আগ্রহী। একে অন্যের প্রতি আস্থা ও সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে কাজ করতে রাজি আছে চীন। কৌশলগত অংশীদারিত্ব বলতে কী বুঝানো হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মোঃ শহীদুল হক বলেছেন, আর্থ-সামাজিক, বিনিয়োগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্পর্ক আরো নিবিড় ও গভীর হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ অবকাঠামো, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষিখাতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীন সম্মত হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানিয়েছেন, আমরা একসঙ্গে এক অঞ্চল এক পথ বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছি। দু’নেতার বৈঠকের পর দু’দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগ, অবকাঠামো, সড়ক, রেল, নৌপথ, আইসিটি তথ্য, মেরিটাইম সহযোগিতা ইত্যাদিসহ নতুন কয়েকটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দু’নেতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রকল্পগুলো হলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইন্সটিটিউট স্থাপন, কর্ণফুলী নদীর নীচ দিয়ে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ, পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, চার স্তরের জাতীয় তথ্যভা-ার, চট্টগ্রামে ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও শাহজালাল সারকারখানা নির্মাণ। দু’নেতাই বলেছেন, তাদের আলোচনা অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে।
দু’দেশের মধ্যে যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে চীনের অর্থ সহায়তার পরিমাণ কত হবে, সুনির্দিষ্ট করে তা জানা না গেলেও এক খবরে বলা হয়েছে, তা প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, ৩৪টি প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পাবে ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এত বিপুল আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশ পায়নি। স্মারকভুক্ত ২৮টি প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ২১.৫ বিলিয়ন ডলার পাবে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সূত্র জানিয়েছে। ওদিকে দু’দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১৩টি বড় বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। উভয় দেশের ২৬টি কোম্পানি ১৩৬০ কোটি মার্কিন ডলারের এই চুক্তি করেছে। চুক্তির আওতায় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগসহ বেশ কয়েকটি খাত রয়েছে। চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এগুলো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সামুদ্রিক অর্থনীতি, বিসিআইএমইসি, সড়ক ও সেতু, রেল, জ্বালানি, সামুদ্রিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শিল্পোৎপাদন, সামর্থ্য বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকভুক্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি দ্রুতায়িত হবে। অনুরূপভাবে দু’দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সব বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে সেগুলো কার্যকর হলে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা আরও জোরদার হবে। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তা বাংলাদেশের স্বার্থে ও কল্যাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্জন কাজে লাগাতে হবে যথাসময়ে ও যথাযথভাবে। দু’দেশে ২০১৭ সালকে বিনিময় ও বন্ধুতার বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। এই বিনিময় ও বন্ধুতা আগামীতে আরো সম্প্রসারিত ও গভীর হবে, এটাই সকলে প্রত্যাশা করে।
চীন বাংলাদেশের অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধু। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক আড়াই হাজার বছরের পুরনো। এই যোগাযোগ ও সম্পর্কের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই বর্তমান সম্পর্কের সৌধ নির্মিত হয়েছে। প্রাচীন কালের সামুদ্রিক রেশম পথ ও দক্ষিণ রেশম পথ ছিল দু’দেশের যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মাধ্যম। পরবর্তীকালে রেশম পথ অকার্যকর হয়ে পড়লেও দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ, সম্পর্ক ও সহযোগিতা থেমে যায়নি। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশীদার। চীনের বিনিয়োগ ও সহযোগিতায় বেশকিছু সর্বাধুনিক নির্মাণ কাজ বাংলাদেশে হয়েছে। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ চলছে। চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে কাজ করছে। এছাড়া প্রতিরক্ষা, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি খাতেও সহযোগিতা বিদ্যমান রয়েছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়ে দু’দেশ কাজ করে যাচ্ছে। স্বপ্নের মিল থাকায় দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনাও অপার। চীন সুদূর অতীতের রেশম পথ পুনরুদ্ধার ও সচল করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তার এক অঞ্চল এক পথ কৌশল মূলত ওই রেশম পথ পুনরুদ্ধারেরই কৌশল। চীনের এই প্রয়াস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের এই বিশেষ গুরুত্ব। রেশম পথ দু’টি পুনরুদ্ধারিত ও কার্যকর হলে বাংলাদেশ তার অবস্থানগত কারণেই ব্যাপকভাবে সুবিধাভোগী হবে। এক অঞ্চল এক পথ কৌশলে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার যে সিদ্ধান্ত চীনকে জানিয়েছে, সেটা সুদূরপ্রসারী ও দূরদৃষ্টিসঞ্জাত একটি সিদ্ধান্ত। চীন এমন একটি দেশ যে কখনো প্রতিবেশী বা বন্ধুপ্রতীম দেশে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে না। গত ৪১ বছর বাংলাদেশও সেটা প্রত্যক্ষ করেছে। চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন। এই লক্ষ্যেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য সে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, তার এ প্রচেষ্টায় সংযুক্ত ও সহযোগী হলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবে। আমরা আশা করতে চাই, এই সামগ্রিক পটভূমিতে বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা আগামীতে আরও প্রসারিত, ঘনিষ্ঠ ও জোরদার হবে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন