শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হাসপাতাল নয় বাঁচবে সিআরবি

রেলমন্ত্রী বললেন আইনি বাধা এবং চট্টগ্রামবাসী না চাইলে প্রকল্প বাতিল

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

অবশেষে সুরক্ষা পাচ্ছে চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ ও ‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি’ খ্যাত সিআরবি। প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে সেখানে হাসপাতাল হচ্ছে না। সিআরবি রক্ষায় টানা চার মাস লাগাতার আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। সিআরবিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতালের নামে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে আসছে সরকার। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন স্পষ্ট জানিয়েছেন, আইনি বাধা এবং চট্টগ্রামবাসী না চাইলে সিআরবিতে হাসপাতাল হবে না।

গতকাল সোমবার রেলভবনে সিআরবি সুরক্ষায় আন্দোলনকারী সংগঠন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময়কালে মন্ত্রী এ আশ^াস দেন। পাহাড়ে প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত শত বছরের বৃক্ষরাজিতে ঘেরা ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক সিআরবিতে হাসপাতালের নামে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ব্যতিক্রমী এক সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলনে শরিক হন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, স্থপতি, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ সর্বস্তরের মানুষ।

সিআরবিতে হাসপাতাল হচ্ছে না এমন ঘোষণায় স্বস্তি এবং আনন্দ প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দীর্ঘ আন্দোলনের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তারা। নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল রেলমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত শেষে ইনকিলাবকে বলেন, মন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন আইনি বাধা থাকলে এবং চট্টগ্রামবাসী না চাইলে সিআরবিতে কোন হাসপাতাল হবে না। আমরা মন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি হেরিটেজ ঘোষিত সিআরবিতে হাসপাতাল করার আইনগত কোন সুযোগ নেই। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। আর চট্টগ্রামবাসী এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। আমরা হাসপাতাল চাই তবে সেটা সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়।

ইব্রাহিম হোসেন বাবুলের নেতৃত্বে টানা তিন ঘণ্টা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রেলমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। সেখানে মন্ত্রী বলেন, সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প রেল মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি। এটি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পিপিপি অথরিটির প্রকল্প। বিনিয়োগও বেসরকারি। সুতরাং রেল মন্ত্রণালয়ের এখানে করার কিছুই নেই। মন্ত্রী বলেন, হাসপাতাল করতে হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে নকশা অনুমোদন দিতে হবে। সিডিএ যদি নকশা অনুমোদন না দেয় সেখানে হাসপাতাল হবে কী করে? আর অন্যান্য সংস্থার অনুমোদনে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেখানে কোনও কিছু করা সম্ভব না।

নাগরিক সমাজের দেওয়া যাবতীয় তথ্য উপাত্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন জানিয়ে তিনি বলেন, তিনিই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে আমার অভিমত হচ্ছে, আইন ও চট্টগ্রামবাসীর সেন্টিমেন্টের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা যা কিছু করছি জনগণের কল্যাণে। জনগণের কল্যাণে সরকার প্রকল্প গ্রহণ করে।

মতবিনিময়কালে মন্ত্রীর কাছে প্রকল্পের যাবতীয় অসঙ্গতি তুলে ধরে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেন নাগরিক সমাজ- চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল। এ সময় তিনি মন্ত্রীকে বলেন, সিআরবি হচ্ছে ২০০৯ সালের গেজেট অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট অনুমোদিত সরকার ঘোষিত হেরিটেজ জোন। এখানে কোনও ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা হতে পারে না, এটি আইনত নিষিদ্ধ। এটি সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। তাছাড়া এটি চট্টগ্রামের ফুসফুস এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

চাকসু জিএস শহীদ আবদুর রব, শহীদ মনোয়ার, শহীদ শেখ নজিরসহ ৯ শহীদের কবর এই সিআরবিতে। এখানে কোনও স্থাপনা হলে শহীদের কবর ধ্বংস হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিনষ্ট হবে। তিনি বলেন, আমরা হাসপাতালের বিপক্ষে নই। হাসপাতাল চাই। তবে সিআরবিতে নয়। সিআরবি ছাড়া অন্যত্র হাসপাতাল হলে আমরা স্বাগত জানাবো।

মতবিনিময়কালে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক সমাজ-চট্টগ্রামের কো-চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুস, আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, জাসদ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন বাবুল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচএম জিয়াউদ্দিন, নাগরিক সমাজ-চট্টগ্রামের যুগ্ম সদস্য সচিব ও বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, প্রণব চৌধুরী, অ্যাডভোকেট রাশেদুল ইসলাম, অনির্বাণ দত্ত, অ্যাডভোকেট মাসুদুল আলম চৌধুরী, ব্যারিস্টার হেলালউদ্দিন ও ব্যারিস্টার হারুনর রশীদ প্রমুখ।

গত বছর সিআরবি এলাকায় রেলওয়ে হাসপাতাল ও সংলগ্ন খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি স্টাফ কোয়ার্টারের ছয় একর জমিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্পের চুক্তি সই ও অনুমোদন হয়। বেসরকারি ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান ছয় একর জমিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট করতে চায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ১২ বছর। ৫০ বছর পর হাসপাতালটি রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। সিআরবিতে বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামে নগরবাসী। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ওয়াসাসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হেরিটেজ ঘোষিত সিআরবিতে কোন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হবে না। এ ঘোষণায় সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে নতুন গতি আসে।

রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও সিআরবি সুরক্ষায় রাস্তায় নামে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ সমাবেশের পাশাপাশি সিআরবি সাত রাস্তার মাথায় স্থাপিত মঞ্চে ব্যতিক্রমধর্মী সব কর্মসূচি পালিত হয়। মশাল মিছিল, হাসপাতাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে লাল পতাকা প্রদর্শন, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, সাইকেল র‌্যালি, প্রতিবাদী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, প্রকৃতি সুরক্ষায় গাছের শাখায় পাখির বাসা স্থাপনসহ হরেক রকমের কর্মসূচি পালিত হয়।

নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের পাশাপাশি সিআরবি সুরক্ষা মঞ্চ, নাগরিক উদ্যোগ বিভিন্ন সংগঠন লাগাতার কর্মসূচি পালন করে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এবং বিভিন্ন ইসলামী ও বাম সংগঠন প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে। পাহাড়-প্রকৃতি ঘেরা চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় নিকট অতীতে ব্যতিক্রমী এমন আন্দোলন আগে কখনো দেখা যায়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন