সুন্দরবনের খাল ও নদীতে নজরদারির অভাবে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ হচ্ছে না। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, জেলে নামধারী সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্যদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছে। এর ফলে মৎস্যসম্পদ ও জলজ প্রাণী হুমকির মুখে।
অন্যদিকে বিষ প্রয়োগে ধরা এসব মাছ যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন আড়তে। এতে মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা বাড়ছে। এভাবে মাছ ধরায় মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ জেলের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষ দিলে মাছের সঙ্গে সব প্রজাতির জলজ প্রাণীই মারা যায়। এটা জীববৈচিত্রের জন্য খুবই মারাত্মক। পরিবেশের ওপর যেমন বিরূপ প্রভাব পড়ে অন্যদিকে বিষে মরা ওই মাছ খেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী। কীটনাশক বা বিষ যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। দুষ্কৃতকারীরা সেখান থেকে শুধু বড় মাছগুলো সংগ্রহ করে। ছোট মাছগুলো তারা নেয় না। কিন্তু এই ছোট মাছগুলো ছিল বড় মাছের খাবার। ফলে ওই এলাকার খাদ্যচক্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আবার এই কীটনাশকমিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রে যায়, তখন সেই এলাকার মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুন্দরবনের বেশ কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা বেড়েছে। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বসবাস বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য মাছ ধরা, গোলপাতা ও মধু আহরণসহ নানাভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কিছুদিন ধরে অসাধু মাছ শিকারি স্থানীয় টহল ফাঁড়ির বন কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে সুন্দরবনের আওতায় বিভিন্ন খালে বিষ প্রয়োগে অবাধে মাছ শিকার করছে।
জেলেরা বলেছেন, সুন্দরবনে সরকারি পাশ-পারমিটের রাজস্ব ২৪ টাকা ৫০ পয়সা। সেখানে কালাবগি স্টেশনে জনপ্রতি নেয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। নৌকায় তিনজন হলে ২ হাজার টাকা দিতে হয়। চারপাটা ও খেপলা জালে ২ জনে ১ হাজার ও বেন্দি জালের জন্য জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে দিতে হয়। বিএলসি নবায়নে ৭৫ থেকে ১১০ টাকা রাজস্ব প্রদানের নিয়ম হলেও ২ হাজার টাকা করে নেয় বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
উপকূলীয় এলাকা ও বন বিভাগের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা বনে প্রবেশের সময় নৌকায় বিষাক্ত কীটনাশক নিয়ে যায়। পরে জোয়ারের আগে কীটনাশক চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে নদী ও খালের পানির মধ্যে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কীটনাশকের তীব্রতায় নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। তারা ওই মাছ উঠিয়ে প্রথমে স্থানীয় আড়তে নিয়ে যায়। বিভিন্ন বাজারসহ বিভিন্ন শহরে বাস-ট্রাক ও পিকআপযোগে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অথচ মাছে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করার কোনো পরীক্ষাগার বন বিভাগের নেই।
বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে ইনকিলাবকে বলেন, সুন্দরবনে অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও জেলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সাথে সম্পৃক্ত। প্রায় সময়েই অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তারা দ্রুত আদালত থেকে জামিনে এসে আবার একই কাজ করে। গ্রেফতারের পর কেন দ্রুত জামিনের বেরিয়ে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ শনাক্ত করার মেশিন আমাদের কাছে নেই। তাই এ বিষয়ে প্রমান আদালতে উপস্থান করা যায় না।
বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও এ প্রক্রিয়ার সাথে বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা ও সদস্য সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। তবে অভিযোগ একেবারেই কম বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বন বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিষ দিয়ে মাছ ধরায় জেলেদের অনেকই একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রমানের অভাবে দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তি এদের জামিন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
সুন্দরবনের স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জ বনবিভাগের গেওয়াখালী, পাতকোষ্টা, ভোমরখালী, চিন্তামণি, কালিরখাল, ছেঁড়া, ঝঁপঝঁপিয়া ও মুচিখালীসহ বিভিন্ন খালে বিষ ঢেলে মাছ ধরা হচ্ছে। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা এই দুই রেঞ্জেই এক দশক ধরে এই সর্বনাশা কর্মকাণ্ড চলে আসছে।
তবে চাঁদপাই রেঞ্জেই মৎস্যদস্যুদের অপতৎপরতা তুলনামূলক বেশি। এ রেঞ্জের জোংড়া, ঢাংমারী, বৈদ্যমারী, জয়মনী, কাটাখালী, জিউধরা, নন্দবালা, ঘাগরামারী, হারবাড়িয়া, শুয়ারমারা, হরিণটানা, নলবুনিয়া, আন্ধারমানিক, মরা পশুর, ঝাঁপসি, লাউডোব ও সংলগ্ন নলিয়ান রেঞ্জের কালাবগী, ঝনঝনিয়া, হলদিখালী, টেংরামারী, ভদ্রা, কোরামারীসহ বনের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন খাল ও নদী এলাকায় এখন কীটনাশক বা বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন