শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঢামেকে ‘রোগী জিম্মি অ্যাম্বুলেন্সে’

প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ‘সাড়ে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কবিগুরু তুমি দেখে যাও, তোমার কবিতা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে...’। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে আমরা ৪৪ বছরেও কি সত্যিই ‘মানুষ’ হতে পেরেছি? নাকি বিভিন্ন সেক্টরে সিন্ডিকেটের জিম্মি দশায় নিপতিত হয়েছি!
প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দিন দিন জিম্মি হয়ে যাচ্ছি। রাজনীতিতে জনসেবার নামে রাজনৈতিক দলের হাতে জিম্মি। সড়ক পরিবহন, রেল, নৌপথ প্রতিটি সেক্টরে আমরা কিছু মানুষের হাতে জিম্মি। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে তেল, ডাল, চাল, চিনি, লবণের ক্ষেত্রে একই জিম্মিদশা। হঠাৎ করে সিন্ডিকেট কোন পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেবে বলা মুশকিল। বাধ্য হয়েই মানুষকে বেশি দামে সে পণ্য ক্রয় করতেই হয়। সড়ক পরিবহনের জিম্মিদশা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। যাত্রীদের ভাড়া বৃদ্ধিতে মনে হয় গোটা পরিবহন ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাজনীতিকদের হাতে ভোটের অধিকার জিম্মি, কোচিং সেন্টারের কাছে শিক্ষা ব্যবস্থা জিম্মি, ডাক্তারদের কাছে রোগীরা জিম্মি। এ এক ভয়াবহ অবস্থা। জিম্মি, সিন্ডিকেট, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা শব্দগুলো যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়েছে; কিন্তু মানুষ কি ৪৪ বছরেও মুক্তি পেয়েছে? আমরা সত্যিকারের মুক্তি পাবো কবে?
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসার রোগীরা ‘নির্দয় অ্যাম্বুলেস’ সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে পড়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এ হাসপাতালে কোনো না কোনো সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে। এটা যেন নিয়তি! এতোবড় সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৪টি অ্যাম্বুলেন্স? এ চিত্র কল্পনা করা যায়? প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অর্থ যায় কোথায়? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যক্তি মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী! অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী প্রায়ই দাবি করেন স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে ৪টি অ্যাম্বুলেন্স এটা দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যের প্রকৃত চিত্র। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের নিচে পড়ে ৫ জনের মৃত্যুর পর চিকিৎসা নিতে আসা হাজার হাজার রোগীকে অবর্ণনীয় দুর্দশায় ফেলেছে অ্যাম্বুুলেন্স সিন্ডিকেট। অথচ দায়িত্বশীলরা ‘রোগীদের সেবার জন্য আরো সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দরকার’ বলেই দায়িত্ব শেষ করছেন! এতো বড় হাসপাতাল ব্যক্তিমালিকানাধীন ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটে’র ওপর নির্ভরশীল!
দু’দিন থেকে যারা টিভির সচিত্র প্রতিবেদন দেখছেন তারা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের আহাজারি আর রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের ফরিয়াদের অন্ত নেই। তাদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় রোগীদের আনার-নেয়া করা হচ্ছে ভ্যানে, রিকশা, ব্যাটারিচালিত গাড়িতে। অনেক রোগীকে এ ধরনের বিকল্প বাহনে নেয়া সম্ভব না হওয়ায় স্বজনরা ঘাড়ে-কাঁধে করে আনা-নেয়া করছেন। অথচ কর্তৃপক্ষ ‘৫টি অ্যাম্বুলেন্স তার মধ্যে একটি নষ্ট’ বক্তব্য দিয়েই খালাস! প্রশ্ন হলো দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেলে যদি ৪টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে চলে তাহলে দেশের অন্যান্য সরকারি মেডিকেলের চিকিৎসা সেবার অবস্থা কি? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের রোগীরা জিম্মি নয়; চিকিৎসা নিতে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সবকিছুতেই ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা। হাসপাতালের ভিতরেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করে রোগীদের ফাঁদে ফেলা হয়। হাসপাতালে ভর্তি, ওয়ার্ডে আসন পাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদে পদে রোগীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয় এই সিন্ডিকেটের হাতে। সেবার নামে ‘অ্যাম্বুলেস সেবা’ নিয়ে হাসপাতাল ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি বড় সিন্ডিকেট। এরা একই সঙ্গে রোগীদের নানাভাবে প্রতারিত করছে। বিভিন্ন হাসপাতালের ‘এজেন্ট-দালাল’ হিসেবেও কাজ করে এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। আর এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। অসহায় রোগীকে ঘিরে তারা গড়ে তুলেছেন নানান বাণিজ্য। ঢাকা মহানগরীতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সর্বনিম্ন ভাড়া ৩শ’ টাকা। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের স্বল্পতার সুযোগে এসব ব্যবসায়ী চক্র রোগীদের জিম্মি করে তাদের নির্ধারিত মূল্যেই গন্তব্যে যেতে বাধ্য করে। ভাঙাচুরা ও লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্স দিয়েই অধিক ভাড়ায় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রোগী আনা-নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ (মিটফোর্ড হাসপাতাল), হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট, শিশু হাসপাতাল ও অর্থোপেডিক হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালকে ঘিরে এসব অ্যাম্বুলেন্স চক্র গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালের কর্মচারী ও দালালরা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার নামে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেছে।
শনিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে অ্যাম্বুলেন্সের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারায় ৫ জন। তারা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছিলেন। ঘটনার পর অ্যাম্বুলেন্স চালককে গ্রেফতার করা হয়। আর যায় কোথায়! ৫ জনকে খুন করার দায়ে গ্রেফতারকৃত ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়ার দাবিতে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট সব অ্যাম্বুলেন্স অন্যত্র সরিয়ে নেয়। এতে সহায়তা করে হাসপাতারের কর্মচারীরাই। বিপাকে পড়ে যায় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। তাহলে কি ৫ জনের খুনির বিচার হবে না? অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হোতারা এমন দাবির সাহস পায় কোথা থেকে? উত্তর সহজ ‘মন্ত্রী’। একজন মন্ত্রী রাস্তায় গরু-ছাগল চিনতে পারলেই ড্রাইভিং লাইন্সেস দেয়ার নির্দেশনা দেন। অত:পর বাস-ট্রাকের ড্রাইভারেরা মন্ত্রীর আস্কারা পেয়ে একের পর এক দাবি তোলেন। মন্ত্রীদের আস্কারার ফলোশ্রুতিতে ঢামেকের অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হোতারা এখন স্পর্ধা দেখাচ্ছে। প্রশ্ন হলো আমরা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি আর কতদিন থাকবো? চলতি অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ১৭৪৮৭ কোটি টাকা। এ অর্থের শতকরা একাংশ যদি অ্যাম্বুলেন্স ক্রয়ে ব্যয় হতো তাহলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যাম্বুলেন্সের সংকট হওয়ার কথা নয়। তাহলে প্রতি বছর স্বাস্থ্য খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও ঢাকা মেডিকেলের মতো হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স কেনা হয় না কেন? নাকি সেবার নামে অ্যাম্বুলেন্সের সিন্ডিকেটের রোগীদের পকেট কেটে যা পান তার অংশ হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের পকেটে যায়? তা না হলে ঢাকা মেডিকেলে মাত্র ৪ অ্যাম্বুলেন্স থাকবে কেন? সেবার নামে সিন্ডিকেট করে রোগীদের জিম্মি করা হবে কেন? এ কোন মানসিকতা? ঘুরে-ফিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই কবিতাই মনে পড়ে ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। আমরা সত্যিকারের মানুষ হবো কবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
নাসির আহমেদ ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১:২৯ পিএম says : 0
প্রত্যেকটা সেক্টরেই সিন্ডিকেট । সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ।
Total Reply(0)
ইমরান ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১:৩১ পিএম says : 0
সমস্যা হলো এখন বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে।
Total Reply(1)
মাহমুদ ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১:৩৪ পিএম says : 4
ঠিক। তবে দায়িত্ব প্রাপ্ত অনেকেই উদাসীন, দুর্নীতিবাজ ও স্বজনপ্রীতি করছে। যার কারণে সকল সেক্টরের এই করুণ অবস্থা।
সজল ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১:৩৫ পিএম says : 0
আমরা মনে হয় কখনও ই মানুষ হবো না।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন