বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সুন্দরবনে বেপরোয়া চোরা শিকারি

হুমকির মুখে হরিণের অস্তিত্ব। হত্যা করা হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারও

সাখাওয়াত হোসেন, সুন্দরবন থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

সুন্দরবনে চোরা শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে সুন্দরবনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। চোরা শিকারিদের টার্গেট থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যান্য প্রাণীও। বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় তৎপর থাকলেও একাধিক চক্র বিভিন্ন কৌশলে হরিণ শিকার করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড বা পুলিশের হাতে পাচারের সময় ধরাও পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, হরিণ শিকারের জন্য চোরা শিকারিরা সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের দরিদ্র, লোভী জেলে ও অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করে। আর সামান্য আর্থিক লাভের আশায় তারাও ব্যবহৃত হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ সাল থেকে বাঘের চামড়া উদ্ধার শুরু হওয়ার পরই বোঝা যায় এর চাহিদা আকাশচুম্বী। ২০২০ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কছে ধরা পড়েছে দেড় শতাধিক বাঘের চামড়া।

বনবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ও জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ ও হরিন শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরনখোলা, রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। বাঘ ও হরিণ শিকারীরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ ও হরিণ হত্যা করে। শিকারিরা বাঘ বা হরিণ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতেই চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। তবে স্থানীয়ভাবে একটি বাঘের চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। সুন্দরবনে বাঘ ও হরিন শিকারের অন্যতম বেলায়েত তালুকদার। ২০০৪ সালে তার কাছ থেকে নয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা ও তিন ফুট চওড়া একটি রয়েল বেঙ্গল বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। চামড়াটিতে কমপক্ষে পাচঁটি গুলির দাগ ছিল। ওই বছরই পুলিশ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরনখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রাম থেকে বাঘ ও হরিণ পাচার দলের নেতা আব্দুল মতিন গাজীকে হরিণের শিং ও অন্যান্য প্রাণির অঙ্গ প্রতঙ্গসহ আটক করে। সে সময় ২টি বাঘ ও ১৩টি হরিণের চামড়াসহ তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। জেলেদের মাধ্যমে খবর পেয়ে গত ৭ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনকর্মীরা চুনকুড়ি রাজাখালী খালের পাশ থেকে বিশালাকার বাঘটির মৃতদেহ উদ্ধার করেন। প্রত্যক্ষদর্শী জেলে সাইফুল ও মোমতেজকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বন বিভাগের কর্মীরা দাঁত ও নখ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাঘের অর্ধগলিত মৃতদেহ পান। স্থানীয়দের ধারণা, হরিণ শিকারি চক্রের পাতা ফাঁদে বাঘটির মৃত্যু হয়েছে। সাইফুল ও মোমতেজ জানান, মাছ শিকারের সময় দুর্গন্ধ পেয়ে জঙ্গলের গহিনে ঢুকে বাঘের মৃতদেহটি দেখতে পান। ধারণা করা হচ্ছে বাঘটিকে জালে আটকে হত্যার পর দাঁত ও নখ নিয়ে গেছে শিকারিরা।

সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান জানান, বাঘ সাধারণত ১৩ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। বয়সের কারণে বাঘটির মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন। অন্তত ১৫-২০ দিন আগে বাঘটির মৃত্যু হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে বন বিভাগ। বিশাল সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের পর্যাপ্ত নৌযান নেই। সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের সাথে বনবিভাগের লোকজনের সম্পৃক্ত থাকার কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুন্দরবনে বণ্যপ্রাণি বা অন্য কোনো অপরাধের সাথে বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

গত সপ্তাহে সুন্দরবন ঘুরে জেলে ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিকারিদের হাত থেকে প্রাণিদের রক্ষা করতে বনবিভাগের কর্মকর্তারা তৎপর থাকলেও চোরা শিকারিরা মাছ বা কাঁকড়ার পাস নিয়ে বনে ঢুকে জাল পেতে স্প্রি বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, কলার মধ্যে বরশি ঝুলিয় রাখা এবং চেতনা নাশক ঔষধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক হরিণ। শিকারীদের শিকার করা হরিণের গোশত, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, শহরের এক শ্রেণির উচ্চ বিলাসী মানুষ ও সমাজপতিদের বাসায়। আবার হরিণের ২/৪ কেজি গোশত দিয়ে করা হয়েছে নানা কাজের তদবীর। কেজি প্রতি এ গোশত ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হরিণের চামড়ারও কদর রয়েছে যথেষ্ট। একটি চামড়া ৫/৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুলাই দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে গভীর সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংসসহ চোরা শিকারি জব্বার গাজীকে আটক করে বনবিভাগ। সুন্দরবনের ধলের খালের মুখ থেকে তাকে আটক করা হয়। গত ২৫ জুন সুন্দরবন সংলগ্ন চুনকুড়ি নদীতে যৌথ অভিযান চালিয়ে ৯৭ হাজার মিটার অবৈধ নেট জাল ও চার হাজার ৮৭০ কেজি জাল ধরা রশি জব্দ করেছে বনবিভাগ, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনবিভাগের একজন কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সুন্দরবনে ক্রমেই বাড়ছে চোরা শিকারির সংখ্যা। এ জন্য অর্থনৈতিক কারণকেই দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, আগে সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেতো। এখন লবণাক্ততার কারণে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। মাছ ধরা ছেড়ে অনেক মাঝিরা চোরা শিকারি হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে গোলপাতা ও গরান বন ধ্বংসের পথে, ফলে বাওয়ালীরাও মাঝিদের পথ অনুসরন করছে। তাছাড়া আগে চোরা শিকারিদের নৌদস্যুদের ভয় ছিল। এখন র‌্যাবের হাতে নৌদস্যুদের আত্মসর্ম্পণের কারণে ওই ভয় আর নেই। ফলে বাঘ ও হরিণ শিকারিরা অবাধে সুন্দরবনের গভীরে গিয়েও শিকার করতে ভয় পাচ্ছে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন