সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি মামলার রায়ে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। গত মঙ্গলবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম ফারমার্স ব্যাংকের কেডিট পলিসি লঙ্ঘন করে ঋণ জালিয়াতি এবং ঋণ করা অর্থ বিদেশে পাচারের পৃথক ধারায় মামলার এই রায় প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে থাকা একজন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগে মামলা এবং বিচারে দোষী সাব্যস্থ হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার নজির আমাদের দেশে এটাই প্রথম। এই উপমহাদেশে এ ধরনের আর কোনো নজির আছে কিনা আমাদের জানা নেই। বিচারিক আদালতে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে রায় ঘোষিত হয়েছে তাতে দেশের বিচারবিভাগের ভাবমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
আইনের চোখে সবাই সমান, আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নন। সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা এবং স্বল্প সময়ে রায়ের মাধ্যমে সাজার এই ঘটনাকে অনেকে বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও আইনের লম্বা হাতের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। এস কে সিনহার বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর দেশের আইনমন্ত্রী, শীর্ষ আইনজ্ঞ, আইন কর্মকর্তাসহ বিচারাঙ্গনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেকে একজন আইনজীবী ও বিচারবিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দাবি করে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন দুর্নীতির অভিযোগে সাজার ঘটনাকে বিব্রতকর বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, এই রায় বিচার বিভাগের জন্য সুখকর নয়। সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এই রায়কে দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করে বলেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আইন মেনে বিচার হলে সাজা সঠিক হয়েছে।
বিচারপতির বিচারের কথা আমরা হরহামেশাই শুনে আসছি। এবার আমাদের দেশেই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি হলো। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির আসনে থাকা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অতীতে আর কখনো উঠেনি। এ কারণে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সম্পর্কে উচ্চ ভাবমর্যাদা রয়েছে। বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদিন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ফৌজদারি মামলায় একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির কারাদণ্ডের আদেশ আমাদের দেশ ও জাতির জন্য গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা নয়। অনুপস্থিতিতে সাজার এই আদেশ বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করবে না বলে তিনি মনে করেন। বিচারপতি এস কে সিনহা ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর দেশত্যাগের পর ১১ নভেম্বর বিদেশে থেকেই পদত্যাগ করেন। বিদেশে থেকেই লেখা তাঁর বই ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল’ হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর এই গ্রন্থ ও তার বিষয়বস্তু দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। তিনি বাংলাদেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে লিখেছেন বটে, তবে এখন তিনি নিজেই ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের মতো গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হলেন। বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হয়তো উচ্চ আদালতে আপিল হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় শেষতক যাই ঘটুক না কেন, সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ এবং বিচারে সাজা প্রদান দেশের বিচার বিভাগের জন্য স্বস্তিদায়ক ঘটনা নয়। এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে দেশের সব ঋণ জালিয়াত রাঘব বোয়াল এবং অর্থ পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হলে দেশে আইনের শাসন, বিচারবিভাগের স্বচ্ছতা ও সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতি দমন সম্ভব হতো। পক্ষে-বিপক্ষে যাই বলা হোক না কেন, বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে এই রায় দেশের বিচারিক ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন