বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

‘তওবাকারীকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন’

সৈয়দ আহমাদ উল্লাহ কামালী | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
রহমতের ফেরেশতাগণ বললেন, এই ব্যক্তি তওবা করতে এসেছিল এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর দিকে তার আগমন ঘটেছে। আর আযাবের ফেরেশতাগণ বললেন, এ লোক এখনো ভালো কাজ করেনি (এই জন্য সে শাস্তির উপযুক্ত)। এমতাবস্থায় একজন ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে উপস্থিত হলেন। ফেরেশতাগণ তাঁকে সালিস মানলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন যে, তোমরা দুই স্থানের দূরত্ব মেপে দেখ। (অর্থাৎ এ লোক যে স্থান থেকে এসেছে সেখান থেকে এই স্থানের দূরত্ব এবং যে দেশে যাচ্ছিল তার দূরত্ব) এই দুই স্থানের মধ্যে সে যার দিকে বেশী নিকটবর্তী হবে, সে তারই অন্তর্ভুক্ত হবে। অতএব তাঁরা দূরত্ব মাপলেন এবং যে স্থানে সে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল, সেই (ভালো) স্থানকে বেশী নিকটবর্তী পেলেন। সুতরাং রহমতের ফেরেশতাগণ তার জান কবয করলেন। বুখারী ও মুসলিমের অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে যে, পরিমাপে ঐ ব্যক্তিকে সৎকর্মশীল লোকেদের স্থানের দিকে এক বিঘত বেশী নিকটবর্তী পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে ঐ সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের স্থানের অধিবাসী বলে গণ্য করা হল।

অন্য আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা ঐ স্থানকে (যেখান থেকে সে আসছিল তাকে) আদেশ করলেন যে, তুমি দূরে সরে যাও এবং এই সৎকর্মশীলদের স্থানকে আদেশ করলেন যে, তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও। অতঃপর বললেন, তোমরা এ দু’য়ের দূরত্ব মাপ। সুতরাং তাকে সৎকর্মশীলদের স্থানের দিকে এক বিঘত বেশী নিকটবর্তী পেলেন। যার ফলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হল। আরও একটি বর্ণনায় আছে, সে ব্যক্তি নিজের বুকের উপর ভর করে ভালো স্থানের দিকে একটু সরে গিয়েছিল। যার কারণে তার তওবা কবুল করে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ।

একজন ব্যভিচারিণী মহিলার তওবা: নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে এক মহিলা জিনা করার কারণে গর্ভবতী হয়ে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে তওবা করে গুনাহ থেকে পবিত্র হতে চাইল। যেমন মুসলিম শরীফে এসেছে- এক মহিলা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট আগমন করলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি ব্যভিচার করেছি। সুতরাং আপনি আমাকে পবিত্র করুন। তখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন। পরবর্তী দিন আবার ঐ মহিলা আগমন করলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি কি আমাকে ঐভাবে ফিরিয়ে দিতে চান, যেমন ভাবে আপনি মা‘ইযকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? আল্লাহর শপথ, নিশ্চয় আমি গর্ভবতী। তখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যদি (ফিরে যেতে না চাও), তবে (আপাতত: এখনকার মত) চলে যাও এবং সন্তান প্রসবকাল সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

এরপর যখন সেই ব্যভিচারী মহিলা সন্তান প্রসব করল তখন সে তার সন্তানকে এক টুকরা কাপড়ের মধ্যে নিয়ে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে আগমন করলেন এবং বললেন, এই সন্তান আমি প্রসব করেছি। তখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যাও তাকে (সন্তানকে) দুধ পান করাও গিয়ে। দুধপান করানোর সময় শেষ হলে পরে এসো। এরপর যখন তার দুধপান করানোর সময় শেষ হল তখন ঐ মহিলা শিশু সন্তানটিকে নিয়ে তার কাছে আগমন করলো এমন অবস্থায় যে, শিশুটির হাতে এক টুকরা রুটি ছিল। এরপর বললো, হে আল্লাহর নবী! (এইতো সেই শিশু) তাকে আমি দুধপান করানোর কাজ শেষ করেছি। সে এখন খাবার খেতে পারে।

তখন শিশু সন্তানটিকে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন একজন মুসলিমকে প্রদান করলেন। এরপর তার ব্যাপারে (ব্যভিচারের শাস্তি প্রদানের) আদেশ দিলেন। তার বুক পর্যন্ত গর্ত খনন করা হল এরপর জনগণকে (তার প্রতি পাথর নিক্ষেপের) নির্দেশ দিলেন। তারা তখন তাকে পাথর মারতে শুরু করল। হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রা:) একটি পাথর নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং মহিলার মাথায় নিক্ষেপ করলেন, তাতে তার মুখমণ্ডলে রক্ত ছিটকে পড়লো। তখন তিনি মহিলাকে একটি গালি দিলেন। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার গালি শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, সাবধান! হে খালিদ! সেই মহান আল্লাহর শপথ, যার হাতে আমার জীবন, জেনে রেখো! নিশ্চয় সে এমন তওবা করেছে, যদি কোন অত্যাচারী ব্যক্তিও এমন তওবা করতো তবে তারও ক্ষমা হয়ে যেতো। এরপর তার জানাযার নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিলেন। অত:পর তার জানাযায় নামাজ আদায় করা হলো। এরপর তাকে দাফন করা হলো।

আরোও বর্ণিত হয়েছে- হযরত ইমরান ইবনুল হুসাইন আল খুযাঈ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন মহিলা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট হাজির হল। সে জিনা করার কারণে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি দন্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছি তাই আপনি আমাকে শাস্তি দিন! আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার আত্মীয়কে ডেকে বললেন, তুমি একে নিজের কাছে যত্ন সহকারে রাখ এবং সন্তান প্রসবের পর একে আমার নিকট নিয়ে এসো। সুতরাং সে তাই করা হলো অর্থাৎ সন্তান প্রসবের পর তাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে নিয়ে এল।

রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাপড় তার শরীরের উপর মজবুত করে বেঁধে দেয়ার আদেশ দিলেন। অত:পর তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার আদেশ দিলেন। অত:পর তিনি তার জানাযার নামাজ আদায় করলেন। হযরত উমর (রা:) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি এই মহিলার জানাযার নামাজ আদায় করলেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছিল? তিনি বললেন, হে উমর! তুমি কি জানো যে, এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তওবা করেছে, যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের সকলের জন্য যথেষ্ট হত। এর চেয়ে কি তুমি কোন উত্তম কাজ পেয়েছ? যে, সে আল্লাহর জন্য নিজের প্রাণকে কুরবান করে দিয়েছে। সুবহানাল্লাহ।

তওবাকারীর জন্য ফেরেশতাগণ দুআ করেন: ফেরেশতাদের দুআ সবাই পায় না। বিশেষ কিছু বান্দা ফেরেশতাদের দুআ পায়, তাদের মধ্যে তওবাকারীগণ অন্যতম। তওবাকারীর মর্যাদা এতই উপরে যে তার জন্য ফেরেশতারা পর্যন্ত দুআ করেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা আরশ ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মু’মিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে যে, হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যপ্ত করে রয়েছেন। অতএব যারা তওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন। সূরা গাফির, আয়াত-৭।

তওবাকারীকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন: আল্লাহর ভালোবাসা কে না চায়? আমরা সবাই চাই। কিন্তু কিভাবে আল্লাহর ভালোবাসা পাবো? হ্যাঁ আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার উপায় আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তওবা কারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে। সূরা বাকারা, আয়াত-২২২।

উপরোক্ত ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, গুনাহ থেকে ফিরে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে তওবা। আর তওবাকারীকে মহান আল্লাহ তায়ালা অত্যধিক ভালোবাসেন। বান্দাহ যখন তার গুনাহের জন্য নিজের ভুল ত্রুটি স্বীকার করে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করে আর আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করে তখন-ই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন এবং তার তওবা কবুল করে নেন। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জীবনের যাবতীয় গুনাহ থেকে তাঁর নিকট তওবা করে পবিত্র হওয়ার এবং একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পূর্ণ আনুগত্যশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: বর্তমান কর্মরত-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন