শেষ বলে পাকিস্তানের জিততে দরকার ছিল ২। ১ রান হলে খেলা যেত সুপার ওভারে। কিন্তু অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বল এক্সট্রা কাভার দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিলেন মোহাম্মদ নাওয়াজ। পাকিস্তানকে হারানোর খুব কাছে গিয়েও এবার হতাশায় পুড়ল বাংলাদেশ। গতকাল মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতেও পাকিস্তান জিতেছে ৫ উইকেটে। বাংলাদেশের করা ১২৪ রান শেষ বলে পেরিয়ে যায় তারা। এতে তিন ম্যাচ সিরিজের সবগুলো হেরে হোয়াইটওয়াশড হলো লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। আগেই দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ নিশ্চিত করায় ম্যাচটি এমনিতে গুরুত্বহীন হলেও বাংলাদেশের সামনে ছিল হোয়াইটওয়াশ লজ্জা এড়ানোর, পাকিস্তানের তিনে তিন করার। এমন ম্যাচের দুই দল খেলে ফেলেছে ৩৯ ওভার। রোমাঞ্চের লেশমাত্র পাওয়া যায়নি। উইকেটে প্রাণ নেই। ব্যাটিংয়েও চার-ছক্কা নেই। বোলাররা দৌড়ে এসে বল ছাড়ছে আঙুল ঘুরিয়ে। স্পিনাররা চেষ্টা করছে যতটা নিচু বাউন্সে বল করা যায়। আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ ২০ ওভারে তোলে ১২৪, মাঝে মাঝে ছন্দপতন হলেও জয়ের সুবাস পেতে থাকা পাকিস্তানও ছিল কক্ষপথে। এমন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দেখতে দেখতে কার ভালো লাগে? স্টেডিয়ামে আসা দর্শকরাও একে একে ছাড়তে শুরু করেছেন আসন।
কিন্তু ম্যাচের শেষ ওভারে যখন পাকিস্তানের ৮ রান দরকার, তখন মাহমুদউল্লাহ হাতে বল তুলে নিলে দর্শকদের মধ্যে হইচই বেড়ে যায়। ২০১৬ সালের বিপিএলে শেষ ওভারে বোলিং করে দুইবার ম্যাচ জেতানোর রেকর্ড আছে মাহমুদউল্লাহ। স্ট্রাইকে থাকা সরফরাজ আহমেদ প্রথম বলে কোনো রান নিতে ব্যর্থ হলে সেই আশার সলতেটাও জ্বলে উঠল। পরের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিলেন সরফরাজ। উল্লাস, উচ্ছ্বাসে মিরপুরে কান পাতা দায়। রোমাঞ্চ আরও ঘনীভূত হয় ওভারের তৃতীয় বলে হায়দার আলীর আউটে। তিনিও ছক্কার মারার চেষ্টায় ক্যাচ তোলেন লং অনে।
মাহমুদউল্লাহ তখন হ্যাটট্রিকের সামনে, ভোজবাজির মতো পাশার দান যেন মুহূর্তেই পাল্টে গেল। পাকিস্তানের জিততে তখন দরকার ৩ বলে ৮ রান। সদ্য ক্রিজে আসা ইফতেখার আহমেদ হ্যাটট্রিক বলেই বিশাল ছক্কা মেরে বল পাঠিয়ে দেন সাইটস্ক্রিনের ওপারে। কিছুটা মিইয়ে যায় লাল-সবুজ সমর্থকদের গর্জন। তবে পরের বলে রাউন্ড দ্য উইকেটে গিয়ে বলটি অফ স্ট্যাম্পের অনেকটাই বাইরে ঠেলে দিয়ে ইফরেখারকে ফাঁদে ফেলেন মাহমুদউল্লাহ। ছক্কা মারার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দেন তিনি। মিরপুরের গ্যালারিতে তখন প্রত্যাশা আর প্রার্থনা। কিন্তু সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
উইকেটে নতুন ব্যাটসম্যান বাঁ হাতি মোহাম্মদ নওয়াজ। এবার আরেকটি নাটকের জন্ম দিলেন আগের ম্যাচের নায়ক। মাহমুদউল্লাহর শেষ বল থেকে তখন পাকিস্তানের প্রয়োজন ২ রান। বাংলাদেশ অধিনায়ক বল ছুড়লেন ক্রিজের একটু ভেতর থেকে। বল দেখতে পাননি বলে নেওয়াজ স্টান্স ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মাহমুদউল্লাহর ছোড়া বলটি যদিও নেওয়াজের স্টাম্প ভেঙেছিল। কিন্তু আম্পায়ার তা ডেড বল দিলেন। এরপর মাহমুদউল্লাহ আবারও খেললেন ছোট্ট একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা। নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকা খুশদিল শাহকে ‘মানকাডিং’ করার একটা সুযোগ পেয়েও যেন নিলেন না তা। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ যখন শেষ পর্যন্ত বলটি করলেন, সেটি নেওয়াজ কাভার দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সীমানার বাইরে। তাতেই ৫ উইকেটের জয় নিশ্চিত হয় পাকিস্তানের।
পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় আগেই নিশ্চিত হয়েছিল আগেই। অর্জনের নেই তেমন কিছু- এমন ম্যাচে নতুন কয়েকজন ক্রিকেটারকে দেখার সুযোগ করে দেওয়াই বরং ভালো। নতুন চেহারার সেই পাকিস্তানকে পেয়েও সুবিধা নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আগে ব্যাটিং করে ৭ উইকেটে ১২৪ রানের বেশি করতে পারেনি স্বাগতিকরা।
শুরুটা অবশ্য আগের দিনের থেকে কিছুটা ভাল। পাওয়ার প্লেতে একটির বেশি উইকেট না হারিয়ে বাংলাদেশ তুলে ৩২ রান। তবে এর ২০ রানই শামীম পাটোয়ারির। ওপেনার নাঈম পাওয়ার প্লেতে মারতে পারেননি কোন বাউন্ডারি। ১২ বলে তখন তার রান ৫। এর আগে একটি বাউন্ডারিতে শুরু করা নাজমুল হোসেন শান্ত অভিষিক্ত শাহনাওয়াজ ধানির বলে হয়ে যান বোল্ড। ৭ রানে প্রথম উইকেট। শামীম অবশ্য শুরুটা ধরে রাখতে পারেননি। লেগ স্পিনার উসমান কাদির আসতেই তার বলে সøগ সুইপে ক্যাচ উঠিয়ে থামেন ২৩ বলে ২২ রান করে।
নাঈম ছিলেন আঁঠার মতো। টি-টোয়েন্টির কোন চাহিদাই মেটেনি তার ব্যাটে। এক প্রান্ত আলগে রেখে বাড়িয়ে গেছেন রানরেটের চাপ। উসমানের আলগা বল পেয়ে কিছু বাউন্ডারি বের করার পরও তার স্ট্রাইকরেট একশো ছুঁতে একবারও। আফিফ হোসেন এদিনও চার নম্বরে নেমে থিতু হয়ে টানতে পারেননি। তারও হন্তারক উসমান। এই লেগ স্পিনারের বলে উড়াতে গিয়ে টপ এজ হয়ে সহজ ক্যাচ ফেরেন ২১ বলে ২০ করা আফিফ।
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর তৃতীয় ম্যাচেও ব্যর্থ। ১৪ বলে করেছেন ১৪। ১৯তম ওভারে এর আগে আউট হয়ে যান নাঈম। ৫০ বল খেলে তার ৪৭ রানের শম্ভুক গতি ইনিংস প্রশ্ন তোলে তার টি-টোয়েন্টি দলে অবস্থান। ব্যাট করার জন্য ম্যাচের সবচেয়ে ভালো সময়টায় নাঈম চাহিদা মতো দ্রুত রান আনতে না পারায় ডুবিয়েছেন দলকে।
রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান ভালোই এগোচ্ছিল। এক-দুই, কিংবা ওভার প্রতি একটি করে বাউন্ডারি। জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল পাকিস্তানের। তবে তাদের ইনিংসে প্রথম ছন্দ পতন বাবর আজমের উইকেট। লেগ স্পিনার আমিনুল ইসলামকে পুল করতে গিয়ে আউট হন তিনি। তার রান ছিল ১৯। এর পরেও মোহাম্মদ রিজওয়ান ও হায়দার আলীর ৪৯ বলে ৫১ রানের জুটিতে জয়ের কাছেই চলে গিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ১৬তম ওভারে রিজওয়ানকে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক শিকার বানিয়ে আউট করেন পেসার শহীদুল ইসলাম। ৪৩ বলে ৪০ রানের ইনিংস খেলেন রিজওয়ান। কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের আউটটাকে চাপ হতে দেননি হায়দার। পরের ওভারেই দুটি ছক্কা মেরে রান রেট নাগালে নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু নাগালে থাকা ম্যাচটিই শেষ ওভারে এসে কঠিন করে জিতেছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নিয়েছেন ইনিংসের শেষ ওভার করা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। এ ছাড়া আমিনুল ও শহিদুল একটি করে উইকেট নিয়েছেন।
এর আগের দুটি ম্যাচও প্রায় শেষ পর্যন্ত গেছে বটে, তবে দুই ম্যাচের মধ্যে যা একটু লড়াই হয়েছে প্রথমটিই। সেদিন ২৪ রানেই ৪ উইকেট হারানো পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত জিতেছে ৪ উইকেটে, শেষ ওভারে গিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের রান হেসেখেলেই ১১ বল আর ৮ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে যান রিজওয়ানরা। প্রথম দুই ম্যাচের মতো কালও টস জিতেছিল বাংলাদেশ, যথারীতি নিয়েছিল ব্যাটিং। মিরপুরের উইকেটে দুপুরের দিকেই ব্যাট করার জন্য থাকে সহায়ক পরিস্থিতি। কিন্তু সেটা আর কাজে লাগল কোথায়? এই উইকেটে সাধারণত সন্ধ্যার দিকে ব্যাট করা হয় কঠিন। বাংলাদেশ আরও কিছু রান করলে গল্পটা ভিন্ন হতে পারত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন