শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর নতুন মিশনে বলিউড নির্মাতা করণ জোহর ও তারকা অক্ষয় কুমার!

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

১৯৭২ সালের ২৬ জুন নোয়াখালির এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে। এটাই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা।’ তাঁর এ কথা যথার্থ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা এবং তাদের ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। সাধারণত একটি দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকে। তারপরও কোনো কোনো দেশে, সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন সময়ে অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র হিন্দুদের দ্বারা অমানবিক এবং নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হচ্ছে। দেশটির সাংবিধানিক নীতি হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা। সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তার ধর্ম পালন করবে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত দেশটিতে এ নীতি কিছুটা হলেও বজায় ছিল। এখন তা উধাও হওয়ার পথে। সেখানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা মুসলমানরা বহুকাল থেকেই দেশটির মূলনীতি এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। কংগ্রেসকে অনেকে ধর্মনিরপক্ষ দল হিসেবে অভিহিত করলেও তার শাসনামলেও মুসলমানরা হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যের একটুও কমতি ছিল না। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দেশটিতে মুসলমানদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ নেই বললেই চলে। ভারতের মন্ত্রীসভা এবং প্রশাসনের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে, সেখানে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতার চিহ্ন রাখার জন্য হাতেগোনা কিছু মুসলমানকে নিয়োজিত করা হয়েছে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের ওপর যেন গজব নেমে এসেছে। অথচ তার সরকারের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে মুসলমানদেরও সমর্থন ছিল। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতায় এসেই মোদি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া রাজনীতি শুরু করেন। তার শাসনাধীন ভারতে মুসলমানরা একেবারে অপাংক্তেয় এবং উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়েছে। তার এখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে বা হিন্দুস্থানে পরিণত করা, যেখানে শতভাগ হিন্দুরাই বসবাস করবে। এ লক্ষ্যে, মুসলমানদের ভারত থেকে বিতাড়নের জন্য যা যা করার দরকার তাই করছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন থেকে শুরু করে উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন করে যাচ্ছে। কাশ্মীরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত হত্যা-নির্যাতন করে মুসলমান নির্মূল করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুসলমান থেকে শুরু করে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জোর করে হিন্দু বানানো হচ্ছে। মাস দুয়েক আগে আসামে পুলিশের গুলিতে নিহত এক মুসলমানের লাশের ওপর এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফটোগ্রাফারের ‘নৃত্যদৃশ্য’র চিত্র সারাবিশ্বেই আলোচিত হয়েছে। ভারতে মুসলমানরা কিভাবে ও কতভাবে নির্যাতন এবং ঘৃণার শিকার হচ্ছে, সব ঘটনার প্রতীক হয়ে উঠে এ চিত্রটি।

দুই.
ভারতকে পুরোপুরি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার মোদির এই মিশনের সাথে যুক্ত হয়েছে কলকাতা থেকে শুরু করে বলিউড, তেলেগু এবং অসমীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একশ্রেণীর শিল্পী ও নির্মাতা। এখানে বলে রাখা ভালো, ভারতের এসব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সিনেমায় বরাবরই হিন্দু ধর্ম এবং তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি প্রাধান্য পায়। যেকোনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় রীতি-নীতি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সিনেমা-নাটকের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে তুলে ধরাই স্বাভাবিক। ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোও তাই করছে। ফলে তাদের সিনেমাগুলোতে কোনো না কোনোভাবে হিন্দু ধর্মের পূজা-অর্চনা থেকে শুরু করে জীবনাচারে ধর্মীয় প্রভাবের চিত্র তুলে ধরা হয় এবং হচ্ছে। এমনকি সিনেমায় অতি আধুনিক ও ধনী পরিবারের ঘরের মধ্যেও পূজার দৃশ্য তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে কলকাতা এবং তেলেগু সিনেমাগুলো অনেক বেশি এগিয়ে। বেশিরভাগ তেলেগু সিনেমা শুরুই হয় মন্দির থেকে। কলাকুশলীদের পূজার দৃশ্য থেকে শুরু করে নাটকীয় সব দৃশ্য মন্দিরে শুটিং করা হয়। এক সিনেমায় একবার নয়, অসংখ্যবার মন্দির ও পূজার দৃশ্য দেখানো হয়। নির্মাতারা দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে উৎসব করার দৃশ্য এবং এসব দৃশ্যকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য তৈরি করেন। কলকাতার সিরিয়ালগুলোর প্রত্যেকটিকে তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতি দেখানো হয়। তাদের দেব-দেবীর জীবন কাহিনী নিয়ে তো অসংখ্য ধারাবাহিক নাটক প্রতিনিয়ত প্রচার করা হচ্ছে। ভারতের এসব সিনেমা ও সিরিয়ালে মুসলমান চরিত্র থাকে না বললেই চলে। থাকলেও চরিত্রগুলোকে এত নিম্নস্তরের দেখানো হয় যে, দেখলেই মনে হবে মুসলমান মানেই একটি নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠী। দারোয়ান, মালি, বাড়ির চাকর, ঝারুদার, কনস্টেবল, পিয়ন থেকে শুরু করে আরও যত নিম্নস্তরের চরিত্র রয়েছে সেসব চরিত্রে মুসলমানদের উপস্থাপন করা হয়। অনেক সময় সিনেমাগুলোতে মুসলমান চরিত্রকে ভয়ংকর ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা হয়। আর এখন নতুন ট্রেন্ড হিসেবে মুসলমান চরিত্রে দাড়ি-টুপি পরিয়ে জঙ্গী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সম্প্রতি বলিউডের খ্যাতিমান নির্মাতা করণ জোহর পরিচালিত এবং প্রধান চরিত্রে অক্ষয় কুমার অভিনীত সূর্যবংশী সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটি দেখলে এর মূল থিম সম্পর্কে যে কারো মনে হবে, মুসলমানরা জঙ্গী এবং ভারতের জন্য হুমকি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সিনেমাটিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদীর প্রচারের মিশন হিসেবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, মোদি সরকারের মুসলমান বিদ্বেষের প্রপাগান্ডা হিসেবে। এর পুরস্কারও করণ জোহর পেয়েছেন। মোদির কাছ থেকে চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, করণ জোহরের মতো একজন নির্মাতাও উগ্র ধর্মান্ধতার দিকে ধাবিত হয়েছেন। অথচ এই করণ জোহরই যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের হামলায় মুসলমানদের ওপর দেশটির পৈশাচিক নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে শাহরুখ খানকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘মাই নেইম ইজ খান’ নামে অসাধারণ এক সিনেমা, যা সারাবিশ্বে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিল। সেই করণ জোহর যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদকে ধারণ করে সিনেমা নির্মাণ করেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তিনি নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার যে সাংবিধানিক চরিত্র, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। অক্ষয় কুমার বলিউডের একজন ভদ্রলোক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের অধিকারী হিসেবে পরিচিত। তিনি তার অতীত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের কথা অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। কয়েক বছর আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এক কনসার্টে পারফরম করতে এসে বলেছিলেন, তিনি এই ঢাকারই পূর্বাণী হোটেলে এক সময় ‘বয়’-এর চাকরি করেছেন। তার এই অকপট স্বীকারোক্তিতে বাংলাদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল। তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। সেই অক্ষয় কুমার যখন স্বেচ্ছায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ উগ্র সাম্প্রদায়িক একটি সিনেমায় অভিনয় করেন, তখন তার সবশ্রেণীর ভক্তদের দুঃখের অন্ত থাকে না। বলা বাহুল্য, একজন খ্যাতিমান ও দক্ষ অভিনেতার অনেক দায়িত্ব ও দায়বোধ থাকে। কোন সিনেমা এবং কোন চরিত্রে তিনি অভিনয় করবেন এবং এতে দেশে-বিদেশে ভক্তদের মাঝে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এসব বিবেচনায় নিয়েই সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যে সূর্যবংশী সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন, এটি যে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার মিশন, তা তিনি বুঝতে পারেননি, এমন মনে করার কারণ নেই। তিনি জেনেবুঝেই করেছেন। বলা যায়, তিনি একটি সিনেমার ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজ দেশের সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্যকে যেমন উপেক্ষা করেছেন, তেমনি তার সংগ্রামী জীবনের অর্জনকেও ম্লান করেছেন। এই যে ওয়াশিংটন পোস্ট সিনেমাটির সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এটি কি তার খ্যাতি বাড়িয়েছে? হ্যাঁ, তিনি যদি মনে করেন, তার দর্শক শুধু হিন্দুরাই হবে, অন্য ধর্মের দর্শকের প্রয়োজন নেই, তাহলে ভিন্ন কথা। এটা তার নিজের চয়েজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এ চয়েজটি সার্বজনীন কিনা? তিনি সার্বজনীন হতে চান কিনা? নাকি নিজেকে অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করে উগ্র ধর্মান্ধতার কুপমুন্ডুকতায় আবদ্ধ রাখতে চান? এত বছরের তার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বিসর্জন দিয়ে উগ্রবাদীতাকে গ্রহণ করা কি তার উচিৎ হয়েছে? উগ্রবাদী একটি রাজনৈতিক ধারাকে সমর্থন দেয়া বা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার মতো সিনেমায় অভিনয় করা কি তার খুব জরুরি ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর তার পরিস্কার করা উচিৎ। সিনেমাটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট যে তির্যক সমালোচনা করেছে, তা কি করণ জোহর ও অক্ষয় কুমার দেখেছেন? এটি কোনো সাধারণ সিনেমাটিক সমালোচনা নয়, বরং উগ্রবাদের মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠীকে কিভাবে নির্মূল করা ও বিদ্বেষের মানসিকতা পোষণ করা হয়েছে, তার সমালোচনা করা হয়েছে। সমালোচনার এক জায়গায় করণ জোহরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, করণ যদি কাশ্মীর নিয়ে কোনো খবর পড়তেন, তাহলে হয়তো বাস্তব পরিস্থিতি পরিবেশন করতে পারতেন। কিন্তু উদ্দেশ্য যখন অপপ্রচার হয়, তখন কে বাস্তব কথা বলতে চায়? ইতোমধ্যেই বিজেপি সরকার করণের এই নতুন শিল্পদর্শনের পুরস্কার দিয়েছে। সমালোচনায় আরও বলা হয়, অক্ষয় কুমারের চরিত্রটির মাধ্যমে ১৯৯৩ সালের বিস্ফোরণ সম্পর্কে কথা বলানো হয়েছে। কিন্তু সুবিধামতো ১৯৯২ সালের মুসলিমবিরোধী হত্যাকাণ্ডকে উপেক্ষা করা হয়েছে। চরিত্রটি সযত্নে ২০০২ সালের গুজরাটের দাঙ্গা, ২০০৬ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ, যা জুমআর নামাজের পরে মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল এবং ২০০৮ সালের একই অঞ্চলে মালেগাঁও বিস্ফোরণে যেখানে ভারতীয় অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন, এসব ঘটনা উপেক্ষা করা হয়েছে। সমালোচনার এক অংশে করণের প্রতি তির্যক মন্তব্য করে বলা হয়, নির্মাতার উচিৎ ছিল অন্তত মোদি ও তার সহযোগিদের চলচ্চিত্রটি লেখার কৃতিত্ব দেয়া। সর্বশেষ মন্তব্যে বলা হয়, বলিউড যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের লালন এবং মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার এই আক্রমণাত্বক উত্তরণ অব্যাহত রাখে, তাহলে এর হাতও রক্তে রঞ্জিত হবে। বক্স অফিসের কোনো রেকর্ডই তা মুছে ফেলতে পারবে না।

তিন.
চলচ্চিত্র একটি দেশের অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। একে সবচেয়ে বড় মাধ্যমও বলা হয়। এর কারণ, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যে কথা ও তথ্য তুলে ধরা হয়, তা দর্শক অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখে এবং মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। একটি চলচ্চিত্র সেটা ভালো কিংবা মন্দ বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত হোক না কেন, তা বিপুল মানুষের মনে গভীর দাগ কাটে। চিন্তার উদ্রেক করে। এ কারণে, মনে দাগ কাটার মতো একটি চলচ্চিত্রকে মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখে। চলচ্চিত্রে একই সঙ্গে শিল্পকলার সবগুলো মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর অপব্যবহারে একটি দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা কিংবা শান্তি বজায় রাখা সহজ। ভারতে শাহরুখ খান, সালমান খান এবং আমির খানদের সিনেমায় আপত্তিকর বক্তব্য তুলে ধরা নিয়ে দর্শক ব্যাপক প্রতিবাদ এমনকি আন্দোলনও করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই একটি দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পরিবারিক ও সমাজিক গঠন, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতি-নীতি, মূল্যবোধ সর্বোপরি রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। যেকোনো দেশের চলচ্চিত্র দেখলে দেশটির এসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায়। ফলে বিশ্বে চলচ্চিত্র মানুষের জানা ও বোঝার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। আমাদের দেশে সত্তর-আশির দশকের চলচ্চিত্রের কথা মানুষ এখনও স্মরণ করে। সে সময়ে প্রযুক্তির অভাবের মধ্যে সাদাকালো ফিল্মে নির্মিত সিনেমাগুলো শুধুমাত্র গল্প, চরিত্র, বলিষ্ঠ সংলাপ, সুললিত গান এবং আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, মূল্যবোধের মেসেজের কারণে মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলত। এমনও সিনেমা রয়েছে, যেগুলো মাসের পর মাস সিনেমা হলে চলত এবং দর্শক দেখত। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ এবং গান দর্শকের মুখে মুখে থাকত। আড্ডা-আলোচনায় এমনকি পারিবারের সদস্যরা এ নিয়ে গল্প করত। দুঃখের বিষয়, প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে এসে আমাদের চলচ্চিত্রের সেই অবস্থা এখন আর নেই। যেসব সিনেমা নির্মিত হয় এবং হচ্ছে, সেগুলোতে আমাদের চিরায়ত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, মূল্যবোধ দেখা যায় না বললেই চলে। এখন আমাদের সিনেমা বা নাটকে ধর্মীয় কোনো আচার-আচরণ দেখানো হয় না, এমনকি সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের কোনো চিহ্নও দেখা যায় না। আগে যেকোনো নাটক বা সিনেমায় আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো দেখানো হতো। এমন অনেক সিনেমা ও নাটক রয়েছে, যেগুলোর টাইটেলে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা থাকত। প্রথম দৃশ্যের শুরু হতো সুবে সাদেকে মসজিদে ফজরের নামাজের আজানের মাধ্যমে। দেখানো হতো, বাবা-মায়ের ফজরের নামাজ আদায় ও মোনাজাতের দৃশ্য, কিংবা কোরআন তেলওয়াতের দৃশ্য। পরিবারিক বন্ধন, আদব-কায়দা, মূল্যবোধ, অন্যায়-অপরাধের অনুশোচনা থেকে শুরু করে ধর্মীয় অনুশাসন সিনেমা ও নাটকে তুলে ধরা হতো। অনেক সিনেমায় তো বিপদের সময় নায়ক-নায়িকা কিংবা অন্যান্য চরিত্রকে আল্লাহর দরবারে প্রার্থণা করা বা ইসলামী গানের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার দৃশ্য দেখানো হতো। হিন্দু সম্প্রদায়ের চরিত্র থাকলে তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হতো। এখন আমাদের যেসব নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে বা নির্মাণ করা হয়, সেগুলোতে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো চিহ্নই দেখা যায় না। আধুনিক যুগের বা নবপ্রজন্মের উছিলা দিয়ে অনৈতিক কথা-বার্তা এবং সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ‘সিঙ্গেল মাদার’-এর অপসংস্কৃতি তুলে ধরে পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করার চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এখন আমাদের সমাজে এগুলোই হচ্ছে। নির্মাতাদের অনেকে এ কথাটি ভুলে বসে আছেন যে, প্রত্যেক দেশের সমাজেই নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ও দিক থাকে। সেগুলো মানুষ এড়িয়ে যায় বা উচ্চরণ করে না। এটাই সভ্যতা ও মূল্যবোধ। অথচ এ সময়ের নির্মাতারা এসব নেতিবাচক দিককেই বাস্তবতার নামে সিনেমা ও নাটকে তুলে ধরছে। আমাদের পরিবার ও সমাজ, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মৌলিক চরিত্র ও বাস্তবতা যে এসব নেতিবাচক দিক নয়, তা তারা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা একবারও ভাবেন না, তাদের পরিবার ও সমাজ কিংবা তাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনরা কোন রীতি-নীতি, মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসন অবলম্বন করছেন। তারা কি দেখেন না, ভারতের সিনেমা ও সিরিয়ালগুলোতে কীভাবে তাদের দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার ও সামাজিক মূল্যবোধকে তুলে ধরছে? সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের কিছু নির্মাতার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় দিকগুলো তুলে ধরলে তারা আর প্রগতিশীল থাকবেন না। তাদের মৌলবাদী বলা হবে। এটা তাদের নৈতিকতার যে দুর্বলতা এবং আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণকে অস্বীকার করা, তা তারা বুঝতে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন। অনেক নির্মাতার মধ্যে এমন প্রবণতা বিরাজমান, তারা পারলে ইসলামকে ধুয়ে দিয়ে নিজেকে প্রগতিশীল ও আধুনিক হিসেবে তুলে ধরতে চান। অথচ তারা দেখেন না, হলিউড-বলিউডের সিনেমাগুলোতে তাদের ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা অন্তত এ কাজটি তো করতে পারেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক আচার-আচরণ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে প্রেরণাদায়ক এবং ইতিবাচক সিনেমা বা নাটক নির্মাণ করতে। সারাবিশ্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদেরই সৃষ্ট একশ্রেণীর বিপথগামী মুসলমানদের দিয়ে বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী তৈরি করে যে পুরো মুসলমান জাতির ওপর অপবাদ চাপিয়ে দিচ্ছে, এর প্রতিবাদে তো সিনেমা নির্মাণ করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ধ্বংস যে খোদ যুক্তরাষ্ট্র করেছে, তা নিয়ে তো হলিউডেই একাধিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে এবং এ নিয়ে অনেক তথ্যচিত্রও প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের নির্মাতারা কি পারেন না, মুসলমানদের অপবাদ দেয়া নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের এ ধরনের ষড়যন্ত্র নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করতে?

চার.
মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে কাজ করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে নতুন একটি প্রতিবেদন (সিপিসি) প্রকাশ করেছে। হালনাগাদ এ তালিকায় দেখা যায়, বেশিরভাগই মুসলমান দেশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বোঝাতে চাইছে, তার করা তালিকায় উল্লেখিত মুসলমান দেশগুলোতে ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই। অথচ যে ভারতে মুসলমানদের কচুকাটা করা হচ্ছে, ধর্ম-কর্ম পালনে বাধা দিচ্ছে, দেশ থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তালিকায় সেই ভারতেরই নাম নেই। নেই এ কারণে যে, ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট বন্ধু। সে বন্ধুর দোষ দেখছে না। এ থেকে বোঝা যায়, দেশ দুটি মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া এবং তাদের জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরার নতুন মিশন নিয়ে নেমেছে। এ মিশনে বলিউডের নামী-দামী নির্মাতা ও তারকারাও জড়িয়ে পড়েছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ বলিউড সিনেমার সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো। আমাদের দেশের মানুষও তাদের সিনেমা দেখে। তারা যখন, এসব সিনেমায় মুসলমান বিদ্বেষ এবং জঙ্গী হিসেবে উপস্থাপনের দৃশ্য দেখবে, তখন কি তাদের ভাল লাগবে? আগেই বলেছি, চলচ্চিত্র অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। এ মাধ্যম একটি দেশের পুরো চিত্র বদলে দিতে পারে। কাজেই বলিউডের সিনেমায় যদি একটি নির্দিষ্ট জাতিকে বিশেষ করে মুসলমানদের জঙ্গী বদনাম দিয়ে নির্মূল করার বিষয় তুলে ধরা হয়, তবে মুসলমান দেশগুলোর সাথে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক টানাপড়েনে যে তৈরি হবে তাতে সন্দেহ নেই।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (17)
Ripon Hossain ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৪ এএম says : 0
বাস্তব কথা উত্থাপন করেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
Total Reply(0)
Najmul Hasan Khandaker ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৪ এএম says : 0
দুজনেই সমকামী, ফালতু।
Total Reply(0)
Fayez Fayez ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৫ এএম says : 0
একদম সঠিক,, লেখক কে অন্তর থেকে ধন্যবাদ
Total Reply(0)
Mss Rahaman ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৫ এএম says : 0
নায়ক হতে হলে আগে মানুষ হতে হয়... ওরাতো হিন্দুত্তবাদকেই লালন করে..
Total Reply(0)
Tasfin Saad ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৫ এএম says : 0
একদম সঠিক কথা, অনেক মুভিতে এগুলা আরো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
Total Reply(0)
Nazmul Hasan ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৬ এএম says : 0
তাদের কাজই হলো উগ্রতা।
Total Reply(0)
Sabbir Ahamed ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৬ এএম says : 0
ভারতের তুলনায় আমাদের দেশ হাজারগুন অসাম্প্রদায়িক এখানে সংখ্যালগু বলে কিছু নেই।
Total Reply(0)
Mahedi Hasan ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৬ এএম says : 0
একদম সত্য ধন্যবাদ ইনকিলাব সত্যের পথে এগিয়ে যান সকল সত্য খবর প্রচার করবেন
Total Reply(0)
Nagir Ahmed ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:০৯ এএম says : 0
এই ভারত 1192 থেকে 1857 পর্যন্ত মুসলিম সুলতানগণ শাসন করেছেন।আর হিন্দুদের হাতে শাসন আসল মাত্র 73 বছর হইছে।আর তাতেই তারা দেশকে নরকে পরিণত করে ফেলছে। আর বিভিন্ন জায়গায় চিতার আগুন তো নিভছেই না।
Total Reply(0)
Kajal Motahar Alam ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৭:১০ এএম says : 0
বর্তমানের ক্ষমতায় উগ্র হিন্দু বাদী বিজেপি সরকারের অনুসারীদের কাছে কি আশা করবেন? India এর আভ্যন্তরীণ দাঙ্গা, মুসলিমদের হত্যা, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া এসবই প্রমাণ করে তারা জঙ্গি. এখন যে যেরকম তারা তো অপরকে সেরকমই মনে করে.
Total Reply(0)
Bencho ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৮:৪১ পিএম says : 0
... journalist. Vul val news publish koren keno vaijan? Erom kore ki lav hoy apnar? ...
Total Reply(0)
SK Nurul Hassan ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৯:১১ পিএম says : 0
একদম ঠিক কথা লিখেছেন
Total Reply(0)
SK Nurul Hassan ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ৯:১১ পিএম says : 0
একদম ঠিক কথা লিখেছেন
Total Reply(0)
Rahul ২৭ নভেম্বর, ২০২১, ১:৫৭ এএম says : 1
তুমি কিছু জানো না ভাই জার্নালিস্ট ! এই সব ভুল খবর রটিয়ে তুমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছো । TRP এর জন্য এই নোংরা কাজ কোরোনা । তুমি জাহান্নামে যাবে ভাই ।
Total Reply(0)
Mono ২৭ নভেম্বর, ২০২১, ১০:০০ এএম says : 1
হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রপোগান্ডা ভালোই ছড়িয়েছন
Total Reply(0)
pallab ২৭ নভেম্বর, ২০২১, ৮:১২ পিএম says : 0
আগে নিজের চরকায় তেল দেন। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন নোয়াখালী হাজীগঞ্জ রংপুর তথা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর করা অন্যায় অত্যাচার
Total Reply(0)
Roni ২৮ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম says : 0
ভারতের মতো বাংলাদেশেও হওয়া দরকার।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন