বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মারাত্মক হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

ভয়াবহ দূষণের কবলে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম | আপডেট : ১০:০৫ এএম, ২৬ নভেম্বর, ২০২১

  • দূষণ রোধের ৫০ কোটি টাকা ব্যয়েও কোনো সুফল মেলেনি
  • লেকের পানির উৎকট গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ

রাজধানীর অভিজাত ও কূটনৈতিক এলাকা গুলশান-বনানী-বারিধারা। অভিজাত এ এলাকার লেকটি এখন ময়লা-আবর্জনার এক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পয়োনিষ্কাশনের ময়লা-আবর্জনা ও নোংরা পানিতে কালচে বিবর্ণ হয়ে গেছে লেকের পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ। ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। লেকের পাড়ে মৃদু হিমেল বাতাস উপভোগ করতে ছুটে যান অভিজাত এলাকার অনেক নাগরিক। কিন্তু সে লেকের পানি এখন এমনই দূষিত যে, এর পাড়ে চলাচলকারীদের নিঃশ্বাসে মুক্ত বাতাসের বদলে বিষাক্ত বাতাস ঢুকছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, লেকের ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পচা পানি মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ময়লা পচা পানির দুর্গন্ধ আর মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিধারার লেক পাড়ের বাসিন্দারা। লেকের পানি এতটাই দূষিত যে রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক) এতে সাইনবোর্ড টানিয়ে জনগণকে সচেতন করেছেন। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকে মাছ ধরা নিষেধ। লেকের মাছ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সচেতনতামূলক এমন সাইনবোর্ড থাকার পরও এ লেকে চলছে মাছের চাষ। তবে কারা মাছ চাষ করছেন তা সিটি কর্পোরেশন জানে না। তাদের অগোচরেই চলছে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এ কর্মকাণ্ড। তবে লেক পাড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিটি কর্পোরেশনের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসেই লেকের এই অস্বাস্থ্যকর পচা পানিতে চলছে মাছ চাষ। মাঝেমধ্যেই এ লেকের মাছ মরে ময়লা পানিতে ভেসে উঠে। তখন মাছ মরার গন্ধ লেকপাড়ের বাসিন্দারের জীবন দুর্বিষহ করে তুলে। তখন লেকের পাড়ে হাঁটা তো দূরের কথা, বাসাবাড়িতেও দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকলেও ভয়াবহ দুর্গন্ধ থেকে এলাকাবাসী রেহাই পান না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিলুফার ইয়াসমীন ইনকিলাবকে বলেন, গুলমান লেকের দূষিত পানিতে যে মাছের চাষ হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। লেকের বিষাক্ত ময়লা-আবর্জনায় মাছের শরীর বাড়ছে। ফলে এ মাছও বিষাক্ত হচ্ছে। এসব লেকের পানিতে ব্যাপকভাবে পলিথিন মিশছে। এসব পলিথিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাও মাছের পেটে যাচ্ছে। এথেকে মানুষের শরীরে ভয়াবহ ক্যান্সারের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
গতকাল লেকেরপাড় ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে সুয়ারেজ লাইনের মলমূত্র এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা গড়িয়ে পড়ছে লেকের পানিতে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ম্যানহোল হয়ে পয়োবর্জ্য পড়ছে। লেকটির বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের ফলে পানি প্রবাহের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আর এ বদ্ধ পানিতে ময়লা-আবর্জনা পচে লেকের পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। মলমূত্র আর ময়লা-আবর্জনার স্তূপে কোথাও কোথাও চর জেগে উঠছে। পানির ওপর ভাসা মল ও ময়লা-আবর্জনার স্তর দিন দিন ভারি হচ্ছে। লেকের পানি পচে বিবর্ণ হয়ে কুচকুচে কালো, আবার কোথাও সবুজ রং ধারণ করেছে। পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
গুলশান-বারিধারা লেকের দূষণ রোধে ৫৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তারা কাজটি শেষ করলেও এ থেকে সামান্যতমও সুফল পাওয়া যায়নি। যে সব আউটলেট দিয়ে ময়লা-আবর্জনা লেকের পানিতে মিশে সেগুলো আগের মতোই রয়ে গেছে। সেগুলো দিয়ে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি লেকের ভেতরে গিয়ে পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে কাজ না করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ওই টাকা নয়ছয় করেছেন এবং তার প্রমাণও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি পেয়েছে। তারপরও অভিযুক্তদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
গুলশান, বনানী এবং বারিধারা এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে লেক আধুনিকায়নে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ৪১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে ছিল। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে, কিন্তু তা হয়নি। এরপর খরচ বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চারবার। তবুও এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ পঞ্চমবারের মতো প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সাথে এর ব্যয় বৃদ্ধি করে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি ১১ লাখ ৩২ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের সংশোধিত নকশাসহ ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধিতে আপত্তি তুলেছে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট এন্ড ডিজাইন) এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস ইনকিলাবকে বলেন, গুলশান, বনানী এবং বারিধার লেক প্রকল্পের সংশোধিতে নতুন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এ কারণে ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ছে। বিষয়টি নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই।
দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে সুয়ারেজ লাইন দিয়ে বর্জ্য লেকের পানিতে পড়ছে। গুলশান-২ নম্বরের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর রোডের বিশাল বাড়ির পেছনে ২টি বড় পাইপ দেখা যায়। সেগুলো দিয়ে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি লেকের ভেতরে পড়ছে। এতে দূষিত হচ্ছে পানি। ৯৬ নম্বর রোডের পূর্ব পাশেও একই অবস্থা। দূষণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বাড্ডা লেকের বিভিন্ন অংশে ঘুরে অনেক স্থানেই এমন দৃশ্য দেখা গেছে। লেকের প্রায় সব অংশ থেকেই পচা পানির দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। এতে লেকপাড়ের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ।
গুলশান ২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা কামরুজ্জামান বলেন, লেকের ময়লা পানির দুর্গন্ধে বাসায় থাকাও কষ্টকর। বাতাসে এই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পুরো এলাকার পরিবেশকে দূষিত করছে। এতে আমরা যারা এই লেক পাড়ে বসবাস করি তারা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছি। অথচ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। এর আগে মরহুম আনিসুল হক যখন মেয়র ছিলেন, তখন যে সব সুয়ারেজের লাইন লেকের সাথে মিশে আছে, সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। ৫০টি লাইনের মধ্যে ৪৫টি তিনি বন্ধ করে ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন সেই আগের অবস্থা। এটি দেখার কেই নেই।
গুলশানে লেকের পাড়ে বাদাম বিক্রেতা আফজল মিয়া বলেন, লেকের পানির দুর্গন্ধে এখানে এখন আগের মতো লোকজন আসে না। আগে প্রতিদিন যে পরিমাণ বাদাম বিক্রি করতাম, এখন তার অর্ধেকও বিক্রি করতে পারি না। লেকের পাশে সুস্থভাবে ১০ মিনিটও বসা যায় না। এখন তো মুখে মাস্ক থাকে বলে গন্ধ কিছুটা কম লাগে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-বারিধারা। ওই এলাকার অস্তিত্বের প্রয়োজনেই লেকের দূষণ ও দখল বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরি। লেকের পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে এর দুর্গন্ধ চারিদিকে বাতাসে ছড়িয়ে গোটা এলাকার পরিবেশকে দূষিত করছে। এতে এলাকার বাসিন্দারা প্রচণ্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। সরকার উন্নয়নের কথা চিৎকার করে বলছে, অথচ মানুষের জীবন রক্ষার জন্য যে পরিবেশের উন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজন সে ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব বলে মনে হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন