শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

৭৭ বছর বয়সী একজন অসুস্থ নারী, যিনি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন, বেগম খালেদা জিয়া মুমূর্ষু অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে দুটিতে সাজাপ্রাপ্ত। একটিতে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত সাজা হাইকোর্ট আপিলে পাঁচ বছর বৃদ্ধি করে ১০ বছর নির্ধারণ করেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘দন্ডিত ব্যক্তির আপিল সাপেক্ষে আদালত লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন যে, আপিলকৃত দন্ড বা আদেশ কার্যকরীকরণ স্থগিত থাকিবে এবং আসামি আটক থাকিলে আরো নির্দেশ দিতে পারিবেন যে তাহাকে জামিনে বা তাহার নিজের দেয়া বন্ডে মুক্তি দিতে পারিবেন।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় প্রদত্ত সুযোগ বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে জোটেনি। সে সুযোগ তিনি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকেও পাননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কত প্রকার ও কী কী হতে পারে, জীবন সায়াহ্নে বেগম জিয়া এবং দেশবাসী সেটা উপলব্ধি করতে পারছে।

উচ্চ আদালত কর্তৃক জামিন নিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি ছিলেন। অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় পরিবারের আবেদনক্রমে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে দন্ডাদেশ স্থগিত করে নিজ বাড়িতে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন। মেডিক্যাল বোর্ড উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করেছে। সরকার দৃঢ়তার সাথে বলছে, বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রার্থনা যেহেতু ইতোপূর্বে সরকার নামঞ্জুর করে নিষ্পত্তি করেছে সেহেতু এ বিষয়টি জব-ড়ঢ়বহ করে পুনর্বিবেচনার আইনগত কোনো বিধান নেই (সূত্র : জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য)। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দন্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দন্ডিত যাহা মানিয়া নেয় সেইরূপ শর্তে যে দন্ডে সে দন্ডিত হইয়াছে, সেই দন্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দন্ড বা দন্ডেরর অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবেন।’ এ ছাড়াও উক্ত ৪০১ ধারায় উপ-ধারা ৬ এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দন্ড স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র দাখিল ও বিবেচনার শর্ত সম্বন্ধে নির্দেশ দিতে পারিবেন।’

ওই আইনে শর্ত মওকুফ করা বা শর্ত শিথিল করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকারের কাছে রয়েছে।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা বর্তমানে অনেক উন্নতমানের। যদি তাই হয় তবে আমাদের দেশের মন্ত্রীসহ ধনীক শ্রেণী চিকিৎসা বা চেক-আপ করানোর জন্য অহরহ বিদেশে যাচ্ছেন কেন? যাদের অর্থ-কড়ি নেই তারাও তো শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। বিদেশে বেগম জিয়ার চিকিৎসার আবেদনটি কি বিবেচনাযোগ্য নয়? চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রধান কারণ ১. পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্ভুল ফলাফল এবং ২. দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী না থাকা।

সরকার বলতে চায় যে, নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার আইনি বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করার বিধান রাখা হয়েছে। ওই ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে যে, ‘আদালত এই দোষে (জামিনের অযোগ্য অপরাধ) অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ১৬ বছরের নিম্নবয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত অক্ষম হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারিবেন।’

মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জামিনযোগ্য ধারায় জামিন নিতে বেগম জিয়াকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট অহরহ জামিনযোগ্য ধারায় জামিন দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সে আইন বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। তিনি অসুস্থ, নারী এবং শারীরিকভাবে কি অক্ষম নন? আইন কি তার প্রশ্নে স্বাভাবিক গতি পেয়েছে?

সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি ও তা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আপিল বিভাগের রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ মোতাবেক, আপিল বিভাগের নিজ প্রদত্ত রায় বা আদেশ পুনঃবিবেচনা করার ক্ষমতা রয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনের ৪০১ ধারায় প্রদত্ত আদেশ কেন পুনঃবিবেচনা করতে পারবে না?

বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আইনগত বহু রাস্তা খোলা আছে। আইনের কাছে মানবতা পরাস্ত হতে পারে না। The Probation of offenders Ordinances 1960 Ges The Probation of offenders Rules 1975 মোতাবেক সরকার যেকোনো সময় যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরার সুযোগ দিতে পারে। অনুরূপ আইন পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই রয়েছে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার সম্পর্কে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত কোনো দন্ডের মার্জনা, বিলম্বনা ও বিরাম মঞ্জুর করিবার অধিকার এবং যেকোনো দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ কিন্তু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোনো আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোনো কারণেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত ৪৯ অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। ফলে ঘুরে ফিরে সব ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর উপরে বর্তায়।

জেলকোড অনুযায়ী বন্দির স্বাস্থ্যের চিকিৎসা করার দায়িত্ব সরকারের। অসুস্থ অবস্থায় কোনো ফাঁসির আসামিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর নিয়ম আইনে নেই। কারাগারে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ কোনো বন্দীকে মেডিক্যাল অফিসারের সার্টিফিকেট ছাড়া শাস্তি কার্যকর করতে পারবে না। জেলকোডের ৫০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে,

‘(১) শাস্তিমূলক খাবার একক বা যৌথভাবে, কিংবা বেত্রাঘাত, কিংবা ৪৬ ধারার (২) উপ-ধারার অধীন শ্রমের পরিবর্তনের কোনো শাস্তি সেই পর্যন্ত আরোপ করা যাইবে না, যেই পর্যন্ত মেডিক্যাল অফিসার যে বন্দীকে শাস্তি দেওয়া হইবে তাহাকে পরীক্ষা না করেন, যিনি, যদি মনে করেন যে বন্দী উক্ত শাস্তি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত, তাহা হইলে ১২ ধারায় বর্ণিত শাস্তি বইয়ের যথোপযুক্ত কলামে সেই অনুযায়ী সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন।

(২) যদি তিনি মনে করেন যে, বন্দী শাস্তি গ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত, তাহা হইলে তিনি যথোপযুক্ত রেকর্ডে তাহার মতামত লিপিবদ্ধ করিবেন এবং বর্ণনা করিবেন যে, বন্দীকে যে ধরনের শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে তাহার জন্য সে একেবারেই অনুপযুক্ত বা তিনি কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করেন কিনা।

(৩) শেষের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণনা করিবেন যে, কী ধরনের শাস্তি বন্দী কোনো প্রকার শারীরিক ক্ষতি ছাড়া গ্রহণ করিতে পারিবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ অসুস্থতার গ্রাউন্ডে যাবজ্জীবন সাজার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত অনেক বন্দীকে জামিন দিয়েছেন, দায়িত্ব নিয়েই এ কথা বলছি। এদিক থেকে বেগম জিয়া আইনি এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে আইন-আদালত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ উন্নতমানের বৈদেশিক চিকিৎসা এখন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে শাসকের সদিচ্ছার ওপর।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Md Mosarof Hossen Akash ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি
Total Reply(0)
MD Sopik ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হোক
Total Reply(0)
মোঃ ইমরান উদ্দিন ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সুচিকিৎসার দাবি তোলার জন্য আপনাকে বিএনপি করতে হবে না। শুধু একজন বিবেকবান মানুষ হলেই হবে
Total Reply(0)
Abu Ahammed Mizi ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৪ এএম says : 0
আল্লাহ তুমি তাকে নেক হায়াত দান করিও আমিন।
Total Reply(0)
Rabby Islam ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
এগুলা ইতিহাস হয়ে থাকবে বেচে থাকলে আমরা অনেক কিছু দেখতে পারবো ইনশাআল্লাহ
Total Reply(0)
Talha Bayazid ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
হিংষার রাজনীতি কবে যে বন্ধ হবে। ৪৫০০ কোটি টাকা লোপাট হল সাবেক অর্থ মন্ত্রী বললেন তেমন বরো কোন অর্থ নয়। আর আজ ৩ কোটি টাকার মামলায় কয়েক বারের নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী কারারুদ্ধ। দেশের কথা কেউ ভাবে না। সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে ব্যাস্ত। বুকে হাত রেখে কোন রাজনীতিবিদ বলতে পারবেন আপনি জনগনের সেবা করেছেন। আপনাদের লজ্জা হীন করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। ধিক্কার জানাই আপনাদের।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন