শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাজপথে অনড় শিক্ষার্থীরা

চালকের লাইসেন্স ছাড়াই হেলপার চালাচ্ছেন বাস ‘বার বার আশ্বাস, আর নয় বিশ্বাস’ স্লোগানে উত্তাল রাজধানী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা, নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান হত্যার বিচার ও  শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়াসহ ৯ দফা দাবিতে গতকাল রোববারও রাজপথে নেমেছিলেন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর, শান্তিনগর, কাকরাইল, মিরপুর, নীলক্ষেত, ধানমণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে মিছিল করে তারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে গতকালের কর্মসূচি সমাপ্ত করেন শিক্ষার্থীরা।

এর আগে রাজধানীর ধানমণ্ডির রাপা প্লাজার সামনে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আজ সোমবার দুপুরে সায়েন্সল্যাব বা রাপা প্লাজার সামনে আবারও বিক্ষোভ শুরুর ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছেড়ে দেন তারা।

শিক্ষার্থীরা গত তিন দিনের মতো গতকালও সড়ক অবরোধ করে যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। কোনো চালকের লাইসেন্স না থাকলে, যানবাহনের কাগজের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের কাছে চালকদের নিয়ে আসছিলেন। পুলিশ সদস্যরা কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে মামলা ও জরিমানা করছিলেন।
গতকাল রাপা প্লাজার সামনে বিকাশ পরিবহনের একটি বাস থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করেন শিক্ষার্থীরা। দেখেন, চালকের লাইসেন্স নেই। পরে বাসের চাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস থেকে নেমে যান। চালকের দাবি, তার সহকারীর কাছে লাইসেন্স, যানজটে আটকে থাকায় আগেই নেমে গেছেন তিনি। এদিকে শিক্ষার্থীরা বাসের চাবি নিয়ে গেলে চালক তাদের কাছে অনুরোধ করছিলেন সেটি ফেরত দেওয়ার। শিক্ষার্থীরাও নাছোড়বান্দা। উপস্থিত এক পুলিশ সদস্যকে দেখে তারা বলছিলেন, দেখেন, চালকের লাইসেন্স নেই। মামলা দেন। এ সময় শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া কাগজপত্র দেখে উপস্থিত ট্রাফিক সার্জেন্টকে মামলা দিতে বলেন।

শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র পরীক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ছিলেন ওসি উৎপল বড়ুয়া। শিক্ষার্থীরা কোনো গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা শেষ করলে দ্রুত সেটি ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন তিনি। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাপা প্লাজার সামনে গতকাল দুই ঘণ্টায় বিভিন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা ও ৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

শিক্ষার্থীরা জানান, বাসের ধাক্কা কিংবা চাপায় পড়ে শিক্ষার্থীরা যতবার আন্দোলনে গিয়েছে, ততবারই আশ্বাসের বাণী শুনতে হয়েছে। কিছুদিন ভাল যায়। আবারও সড়কে রক্ত ঝড়ে, শিক্ষার্থীরা মারা যায়, ফেরে না সড়কে শৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা কাটে না গণপরিবহনে। তাই কোনো আশ্বাস নয় আর কোনো বিশ্বাসও নয়।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের রাস্তায় অবস্থানের কারণে মিরপুর-নিউমার্কেটগামী সড়কে যান চলাচল সীমিত করা হয়। মানিক মিয়া এভিনিউ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের গাড়ি ডাইভারসন করতে দেখা যায়।

ধানমণ্ডি-২৭ এলাকা সরেজমিনে দেখা যায়, নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর বিচার, নিরাপদ সড়ক ও হাফ পাসের দাবিতে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি মোদের একটাই, নিরাপদ সড়ক চাই, আমার ভাই রাস্তায় মরে, প্রশাসন কি করে, জাস্টিস জাস্টিস উই ওয়ান্ট জাস্টিস, আমার ভাই মরল কেন প্রশাসন জবাব চাই, ‘বার বার আশ্বাস, আর নয় বিশ্বাস’ শীর্ষক স্লোগান বিক্ষোভ করে।

লালমাটিয়া মহিলা কলেজের এক ছাত্রী বলেন, আমরা নিরাপদ সড়ক চাই, শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাশের বাস্তবায়ন চাই। বাসে ছাত্রীদের হয়রানির বন্ধ চাই। শিক্ষার্থীদের ড্রেস দেখে বাসে উঠতে না দেওয়া, হাফ পাসের ভাড়া নিয়ে হয়রানি থেকে রেহাই চাই। আর কোনো ছাত্র-ছাত্রীর যেন অকাল মৃত্যু না হয় সেজন্য সড়কে গণপরিবহন চলাচলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা চাই।

আরেক ছাত্রী বলেন, আমরাও ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে সড়কে থাকতে চাইনা। কিন্তু যখন লাইসেন্স নেই এমন কারো হাতে গাড়ীর স্টিয়ারিং থাকে, সেই গাড়ী চাপায় ছাত্র মারা যায় তখন কোনো আশ্বাসেই আমরা আশ্বস্ত হতে পারি না। তাই সড়কে আসা। এবার আশ্বাস নয়, নিরাপদ সড়কের দাবির বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
আন্দোলনে সকাল থেকে সক্রিয় মোহাম্মদপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সিফাত জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমরা আজকের মতো ফিরে যাচ্ছি। তবে কাল আবার আসবো। আশা করছি খুব দ্রুতই গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের ঘোষণা, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের বিষয়ে সরকারি ঘোষণা শুনবো।

ধানমণ্ডি-২৭ এলাকার ট্রাফিক সার্জেন্ট সামশুর রহমান জানান, বেলা আড়াইটার পরপরই শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়তে শুরু করে। পৌনে ৩টার মধ্যে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। সকাল থেকেই যানচলাচল সীমিত ছিল ধানমন্ডি-নিউমার্কেট সড়কে।
এদিকে, একই দাবিতে গতকাল সকাল ১১টার দিকে নীলক্ষেত মোড়ে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে সিটি কলেজের সামনের সড়কে গিয়ে অবস্থান নেন। এছাড়া রাজধানীর শন্তিনগর, কাকরাইল এলাকায়ও আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

উল্লেখ্য, গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহন করা গাড়ির চাপায় নাঈম হাসান নিহত হয়। সেদিন থেকেই নিরাপদ সড়কের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হন। সেদিন থেকে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছিল। টানা ৯ দিন রাজপথে আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।

ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির অন্যতম ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ, লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে পদচারী-সেতুর ব্যবস্থা, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় গতিরোধক বা স্পিডব্রেকার বসানো, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নেওয়া ও সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা। সাড়ে তিন বছর আগে করা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের তোলা দাবিগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা তুলে ধরে গতকালও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সড়ক শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ হবে। এই সময়ে আগের দাবিগুলোর অধিকাংশই পূরণ হয়নি। এই কারণেই সড়কে আবার এক ভাইয়ের রক্ত ঝরল। তাই তো তারা স্লোগান তোলেন, ‘আশ্বাস আর না, বাস্তবায়ন কর না’।
এদিকে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে দিনভর রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক ছাত্রীকে তার বাবাসহ থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় বাসা থেকে তাদের থানায় নিয়ে যায় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, গতকাল ধানমণ্ডি ২৭ এলাকায় সকাল থেকে আন্দোলন করছিল একদল শিক্ষার্থী। দুপুরে ওই ছাত্রী সেখানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার পরিবেশন করে। একই সময়ে আরেকটি ছেলে ওই ছাত্রীর কাছে বিকাশ নম্বর চায় এবং টাকা পাঠানোর কথা জানায়। বিষয়টি পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে। এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা বা লেনদেনের বিষয়টি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতেই ওই ছাত্রীকে তার বাবাসহ থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনে অন্য কারো ইন্ধন কিংবা যোগসাজশ রয়েছে কি না এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, ধানমণ্ডি ২৭ এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝখান থেকে এক অছাত্রকে আটক করা হয়েছে। তার নাম হাফিজুর রহমান। তার কাছ থেকে কিছু ইনজেকশন ও জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন