শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খালেদা জিয়ার অসুখ : বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাকবিতণ্ডা

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

বেগম খালেদা জিয়ার অসুখ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ২৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রথম পৃষ্ঠায় যে প্রধান সংবাদ প্রকাশ করেছে তার শিরোনাম ছিল, ‘ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজপথ/গুজবে দিনভর উত্তেজনা।’ রিপোর্টটি শুরু করা হয়েছে এভাবে, ‘রাজপথের রাজনীতিতে ছিল কার্যত রাতের নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার সুযোগের দাবিতে বিএনপির সরবতা, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটের বাড়তি সতর্কতা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধীদল বিএনপির নেতাদের উত্তপ্ত বাক্যে দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে।’ বেগম জিয়ার অবস্থাকে মির্জা ফখরুল শুধুমাত্র ‘ক্রিটিক্যাল’ বা সঙ্কটজনক বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সেটিকে ‘ভেরি ক্রিটিক্যাল’ বা ‘অত্যন্ত সঙ্কটজনক’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। বেগম জিয়ার মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে ২৩ নভেম্বর বিএনপি সারাদেশে গণঅনশন ও ২৪ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ দিবস পালন করেছে। ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। তার ভাষায় ‘ম্যাডাম জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’। তাঁর যেসব অসুখ সেগুলোর চিকিৎসা পৃথিবীর সব দেশে করা যাবে না। করা যাবে দুনিয়ার মাত্র তিনটি দেশে। দেশ তিনটি হলো আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং জার্মানি। বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার জাহিদ হোসেন বলেন যে, বেগম জিয়ার শরীর ঔষধে সাড়া দিচ্ছে না। তাদের এসব বক্তব্যের পর, দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্ট মোতাবেক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যথা ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে ‘বেগম জিয়া মারা গেছেন’ এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবটি শুধু ঢাকা নয়, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। রাতে পুলিশ প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, কোনো রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়নি। মির্জা ফখরুল বেগম জিয়ার মৃত্যু সম্পর্কিত গুজব নাকচ করেন। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে উদ্বেগ ও আতঙ্কের অবসান ঘটে।
বেগম জিয়া কেমন আছেন সে সম্পর্কে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ট্রাস্টি ডাক্তার জাফরুল্লাহর বর্ণনা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বেগম জিয়াকে দেখতে ‘এভারকেয়ার’ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এসম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার বিকেলে খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম। যা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি। খালেদা জিয়া কতক্ষণ, কয় মিনিট, কয় দিন বাঁচবেন সেটি আমি বলতে পারবো না। তবে এটা বলতে পারি, খালেদা জিয়া চরম ক্রান্তিকালে আছেন। তাঁকে হত্যা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে আছেন। যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারেন। মেডিকেল বোর্ডের ৬ জন সদস্য আমাকে বিস্তারিত বলেছেন। আমি তাদের ফাইলের প্রত্যেকটি লেখা পড়েছি। উনার মুখ দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে, পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। ব্লাড প্রেসার ১০০ এর নিচে নেমে এসেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, বেগম জিয়াকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। আমি ফাইলের প্রত্যেকটা লাইন পড়েছি। কারো মুখের কথায় কিছু বলছি না। সম্ভব হলে আজই (বুধবার) রাতে উনাকে বিদেশে ফ্লাই করা উচিত। আর না হলে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।’ আইনমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আর কোনো বাড়াবাড়ি কইরেন না। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর জীবন রক্ষা করুন। এখন আর কোনো ভানুমতির খেল দেখাইয়েন না। অনুগ্রহ করে আজ থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিন।’ হাসপাতালে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দেখে আসার জন্য ডাক্তার জাফরুল্লাহ প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানান।
॥দুই॥
গত শুক্রবার ইংরেজি ‘ডেইলি স্টার’ বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট করেছে তার শিরোনাম হলো, Next few days very critical. অর্থাৎ ‘পরবর্তী কয়েক দিন অত্যন্ত সঙ্কটজনক।’ রিপোর্টের এক স্থানে বলা হয়, ‘কয়েকটি উৎস চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং এসব উৎস থেকে রক্তক্ষরণ সাময়িকভাবে বন্ধ করা গেছে। কয়েক জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল। সেগুলোও দূর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য ম্যাডামকে বহুমুখী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা কেন্দ্রে (Multispecialty medical centre) পাঠানো উচিৎ।’
ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক (২৬ নভেম্বর) বেগম জিয়ার এন্ডোসকপি (Endoscopy) করা হয়েছে। ডাক্তার জাহিদের মতে, তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা উচিৎ। গত মঙ্গলবার তাঁর বমি এবং পায়খানায় রক্ত দেখা গেলে তাঁর কোলোনোস্কপি (Colonoscopy) এবং এন্ডোসকপি করা হয়। তিনি সলিড ফুড খেতে পারছেন না। তাই তাঁকে শুধু লিকুইড বা তরল খাদ্য দেওয়া হচ্ছে। ২৭ অক্টোবর শনিবার ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয়, বেগম জিয়ার অবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ, তাঁর আরো রক্তক্ষরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
॥তিন॥
গত ২৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিএনপির তরফ থেকে একটি মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ডেইলি স্টার, ডেইলি নিউ এজ, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তরসহ বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত জাতীয় দৈনিকে এই অভিযোগ ছাপা হয়েছে। দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, ‘যুবদলের সমাবেশে মির্জা ফখরুলের প্রশ্ন/খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জন দেওয়া হয়েছিল কিনা।’ রিপোর্ট মোতাবেক মির্জা ফখরুল কলেন, ‘তাঁকে (বেগম জিয়াকে) একটি মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার পরিত্যাক্ত কারাগারে দুই বছরের বেশি সময় আটক রাখা হয়েছিল। রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে এক এগারোর সময় যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল এটি তারই অংশ। স্যাতসেতে কারাগারের কক্ষে ইঁদুর, চিকা ঘোরাঘুরি করতো। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সময় খালেদা জিয়াকে কোনো স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিনা। এ বিষয়ে আমরা পরিষ্কার জানতে চাই। তাদের (সরকার) পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। মির্জা ফখরুল বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেও সরকারের ওপর চাপ আসছে। কিন্তু প্রতিহিংসাবশত সরকার কারো কোনো কথা শুনছে না। মহানগরী দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম প্রশ্ন করেন, কেন বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানো যাবে না? তিনি আশঙ্কা করেন যে, বিদেশের হাসপাতালে স্লো পয়জন ধরা পড়বে (যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর, পৃ: ১ ও ১১)। এই অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি ডেইলি নিউ এজের প্রথম পৃষ্ঠায়, একই তারিখে। বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন যে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তার সর্বোচ্চটাই তারা করেছেন। তারা বলেছেন যে, এর চেয়ে বেশি কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এর চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে যে প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেগুলো বাংলাদেশে নাই। একই অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে ডেইলি স্টারে, ২৬ নভেম্বর (Next few days very critical: প্রথম পৃষ্ঠা হতে জাম্প ২য় পৃষ্ঠায়, প্রথম ও দ্বিতীয় কলাম জুড়ে)।
গত ২৭ নভেম্বর শনিবার বিএনপির এসব অভিযোগের জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসে দলের প্রেসিডিয়ামের সভায় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যদি খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয় তাহলে হুকুমের আসামি হবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কারণ খালেদা জিয়ার পাশে থাকেন বিএনপির লোকেরাই। তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের চিকিৎসকরাই তাঁকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। স্লো পয়জনিং যদি করে থাকে তাহলে পাশের লোকেরাই করতে পারেন।
॥চার॥
চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়া বিলক্ষণ বিদেশ যেতে পারবেন, বলেন আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক বিষয়, আইনের বিষয় নয়। এখন বেগম জিয়া যেভাবে মুক্ত আছেন সেভাবে মুক্ত থাকার আবেদন নাকচ করেছেন উচ্চ আদালত। সেই নাকচের মুখে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেগম জিয়াকে আপন গৃহে থাকতে দেয়া হচ্ছে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের সময় দুটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এখন আবার সেই একই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে ঐ দুটি শর্ত উঠিয়ে নিলেই বেগম জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারেন, বলেন বিচারপতি মতিন। তার সাথে সহমত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম এবং বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিক।
E-mail: journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md Saju Md Saju ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:১৯ এএম says : 0
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে দাও যদি খালেদা জিয়ার কিছু হয় সুস্থভাবে যদি মারা যায় তা হল এই সরকার দায়ী থাকবে এ সরকারকে অনুরোধ করবো উনাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিন না হয় আপনারা এটার জবাব একদিন দিতে হবে
Total Reply(0)
Md Shahabuddin ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২১ এএম says : 0
আওয়ামীলীগ মনেকরে খালেদা জিয়া মারা গেলে বি এন পি শেষ ।এই ধারনা ভুল সে দিন আসতেছে।
Total Reply(0)
S M Shorif Bhiyan ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়া হোক।
Total Reply(0)
Hj Ra Shid ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
খুবই দুঃখজনক আমরা মানুষ হিসেবে লজ্জিত
Total Reply(0)
MD Jayed Ullah ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৪ এএম says : 0
নিন্দুকেরা বলতে শুনেচি, জেল খানায় খালেদাজিয়া র শরিরে স্লো ফয়জন পুশ করা হয়েছে। এখন বিদেশ গেলে তা ফাশ হয়ে যেতে পারে।
Total Reply(0)
Mohammed Suman ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
আমার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মনে হয় আর বেশিদিন থাকবে না আমাদের মাঝে তার শরীর খুবই অসুস্থ তার জন্য দোয়া চাই দেশবাসীর কাছে
Total Reply(0)
Mizanur Rahman ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
এদেশে নুতন কোন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে! তাতে আর কোন স্বৈরতন্ত্র মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না!
Total Reply(0)
Milon Hossain ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ৪:২৯ পিএম says : 0
In fact, none of us in power has been able to build an advanced medical system in the country . So they are growing helpless today for their own needs . Therefore, I urge everyone to be careful and have better treatment system in the country to have time
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন