শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭টি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো ৬৫ হাজার ৯০২ টি। এ সমস্ত সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা সকলেই সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ইবতেদায়ী মাদরাসার সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার ৯৮৭টি, যার একটিও সরকারি নয়। এসকল মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। মেধার ভিত্তিতে এসব স্কুল শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিপরীতে ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য এরকম কোনো ব্যবস্থা নাই। এ জাতীয় বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা শূন্যের কোঠায় রয়ে গেছে। অথচ, মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান! সরকারি এক হিসেব মতে, এত কিছুর পরেও সরকারি প্রাথমিক থেকে প্রতিবছর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২ থেকে ৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে এবতেদায়ী মাদরাসা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ। (shikhabarta.com, 12 September, 2021) স্কুল ও কলেজশিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সরকারি ব্যাপক সুযোগ সুবিধা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের জন্য গড়ে উঠেছে ডিবেটিং সোসাইটি ও ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব। গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের জন্য রয়েছে বিনোদনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য এ জাতীয় কোনো কিছুর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কোনো সেক্টরেই তাদের জন্য এ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। মাদরাসার এসমস্ত বালক-বালিকা এবং কিশোর-কিশোরিরা বিনোদনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা মানবিক গুণাবলী বিকাশে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠান পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। জাতীয়করণের ক্ষেত্রে। প্রতিটি সরকার তার সময়কালে দেশের স্কুল এবং কলেজ জাতীয়করণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বর্তমান সরকার ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। জাতীয়করণের এ তালিকায় মাদরাসাকে যুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশে মাত্র তিনটি সরকারি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। এর প্রথমটি হলো মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা। এ মাদরাসাটি বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা করেনি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮০ সালে। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসাটি পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। দ্বিতীয় সরকারি আলিয়া মাদরাসাটি হলো সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা। এটিও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ আমলে ১৯১৩ সালে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ সরকারি উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তৃতীয় সরকারি আলিয়া মাদরাসাটি হলো সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদরাসা, বগুড়া। এটাও প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব আবু বক্কার সিদ্দিক (র.)। ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এটাকে সরকারিকরণ করেন। মাউশির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৬২টি। ২০১০ সালের আগে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৩৪৮টি। তার মানে গত ১২ বছরে দেশে ৩১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট ২৭১টি কলেজকে সরকার সরকারি ঘোষণা করেছে। উল্লেখিত বর্ণনা এটাই প্রমাণ করে যে, বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, দেশে মাদরাসা শিক্ষা উপেক্ষিত রয়ে গেছে। দেশে ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এ বিশাল শিশু ও যুবশক্তি সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৪ হাজারের মতো। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এ বিশাল জনশক্তি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ইতিপূর্বে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা দেশের শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নেও তাদের অবদান উল্লেখ করার মতো। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তারাও দেশ গড়ায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা নবাব আব্দুল লতিফের কথা উল্লেখ করতে পারি। বাংলার বিখ্যাত এ নবাব ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। কর্মজীবনের রয়েছে তার অভূতপূর্ব অবদান। ১৮৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৭৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদে প্রমোশন পান। ১৮৬২ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সর্বপ্রথম মুসলিম সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। ১৮৬৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মনোনীত হন। একই সালে তিনি কলকাতা মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি গঠন করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতে কলকাতা মাদরাসায় ফার্সি এবং বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তাঁরই নেতৃত্বে হাজী মুহাম্মদ মহসিন ফান্ডের টাকা মুসলিম সন্তানদের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। তিনি ‹আলিগড় বৈজ্ঞানিক সোসাইটি›র সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সহপাঠি ছিলেন। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৮০ সালে ইংরেজরা তাকে নবাব উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে তিনি নবাব বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। ঢাকা আলিয়ার আরেকজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী হলেন সৈয়দ আমীর আলী। তিনি উড়িষ্যার কটকে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় (যেটা পরবর্তীতে ঢাকা আলিয়ায় রূপান্তরিত হয়) ভর্তি হন। তিনি আরবি ভাষা ও ব্যাকরণে যথেষ্ট পন্ডিত ছিলেন। ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে মুসলিম আইনের অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৭৮-১৮৮১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৮৮৪ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ঠাকুর আইনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮৯০ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি নিযুক্ত হন। ঢাকা আলিয়ার অন্য একজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী হলেন মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন। তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়ায় কামিল হাদিস বিভাগে ভর্তি হন। তিনি একই মাদরাসায় প্রভাষক এবং উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাইখুল হাদিস। তিনি সিলেট সরকারি আলিয়ার ২৬ তম অধ্যক্ষ ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে তার সততা ও যোগ্যতা ছিল উল্লেখ করার মতো। আর একজন মাদরাসার শিক্ষার্থীর নাম আমরা গর্বের সাথে উল্লেখ করতে পারি। তিনি হলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সিলেটের কৃতি সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলায় ১৯২৮ সালে তার জন্ম। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায়। তিনি এ মাদরাসায় হাই সেকশনে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি আরবি ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। এছাড়া সিলেট আলিয়া মাদরাসার উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন ছাত্র হলেন: আবু সাঈদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সৈয়দ লোকমান হোসেন, তিনি ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। একই মাদরাসার ছাত্র ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদ সদস্য। এ আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, অতীতে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতি গড়ায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে এ শিক্ষাব্যবস্থাকে দুঃখজনকভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একজন ছাত্রও পাস করেনি এমন কলেজকে সরকার জাতীয়করণ করেছে। অথচ দেশের নামকরা বহু মাদরাসা আছে যাদের পাশের হার শতভাগ। এ মাদরাসাগুলো শুধু শতভাগ পাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আকাশচুম্বী সাফল্য দেখাচ্ছেন। তারপরও এসমস্ত মাদরাসার নাম জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে মাদরাসাসমূহের গরিব শিক্ষার্থীরা যুগের পর যুগ বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। মেধার স্বাক্ষর রেখেও তারা সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। মাসিক বিভিন্ন হারে বেতন দিয়ে তাদেরকে লেখাপড়া চালাতে হচ্ছে। এসমস্ত গরীব শিক্ষার্থী মাসে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা বেতন দিয়ে লেখাপড়া করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বেতন ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যদিকে স্কুল-কলেজের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টা। সেখানে একদিকে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করছে। আর জাতীয়করণের সুবিধা পেয়ে তারা মাসিক মাত্র ৭ টাকা হারে বেতন দিচ্ছে। মিড ডে মিল ও উপবৃত্তি উপভোগ করছে। ফ্রি ড্রেসসহ সরকারি অন্যান্য বিভিন্ন সুবিধা-সুবিধা লাভ করছে। বাংলাদেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতকরা ২৫ ভাগ হলো এমপিওভুক্ত মাদরাসা। এরপরেও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। সরকারি চাকরি তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি চাকরিতে তাদের বিরুদ্ধে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ১০ শতাংশের নিচে। এ ১০ শতাংশের একজনও আবার পূর্ণাঙ্গভাবে মাদরাসার ছাত্র নয়। এদের সকলেই অনার্স ও মাস্টার্স করেছে কোনো না কোনো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অর্থাৎ সরকারি চাকরিরত এসব মাদরাসার শিক্ষার্থী হাফ মাদরাসা ও হাফ কলেজে পড়–য়া। তাদের অর্ধেক সার্টিফিকেট মাদরাসার আর বাকি অর্ধেক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দাখিল এবং আলিম পাশ করে তারা অনার্স ও মাস্টার্স করেছে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এই অনার্স এবং মাস্টার্স দিয়েই তারা চাকরি করছে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় তারা মাদরাসাকে বাদ দিয়ে ছুটছে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এতে ফাজিল এবং কামিল মাদরাসাসমূহ মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় মাদরাসায় উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সরকারি চাকরির আশায় তারা ছুটছে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এতে স্পষ্টতই বলা যায় যে, মাদরাসাসমূহের উচ্চশিক্ষা লোক দেখানো মাত্র। এখানে গুণের এবং মানের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নাই। মূলত: উচ্চ শিক্ষা বলতে জ্ঞানের সৃজনশীলতা ও গবেষণাকে বুঝায়। প্রেষণা ও উন্নত প্রশিক্ষণও উচ্চশিক্ষার অন্যতম উপাদান ও অনুষঙ্গ। আর এ প্রেষণা ও প্রশিক্ষণ জ্ঞানের সীমারেখাকে বিস্তৃত করে। উন্নত প্রশিক্ষণ একজন শিক্ষার্থীকে উদ্ভাবক ও বিশ্লেষক তৈরিতে সহায়তা করে। জ্ঞানের এ বিস্তৃত ধারা মোটামুটিভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে চালু আছে। কিন্তু মাদরাসাসমূহে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নাই। এখানে স্কুল-কলেজের মত পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নেই। প্রেষণার ধারণা নেই, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম নেই। নেই উন্নত গবেষণাজার্নাল ও শিক্ষা ছুটির কোনো ব্যবস্থা। নেই কোনো উন্নত অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি নেই। ২১৫টি কামিল মাদরাসার মধ্যে ৮২তে অনার্স কোর্স চালু আছে। তাও শুধু কোরআন, হাদিস, দা‘ওয়াহ এবং ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে। আবার এ সমস্ত বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করে মাদরাসার প্রশাসনিক পদে চাকরি করার সুযোগ তাদের নেই, যা মাদরাসার জনবল কাঠামোতে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এটা মাদরাসাশিক্ষার সাথে মারাত্নক বৈষম্যমূলক অচরণ। (সূত্র: আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৯, অনুচ্ছেদ ২.১, পৃষ্ঠা ৭) অথচ এ আদেশটি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১), ২৮(৩), ২৯(১) ও ২৯(২) ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোরআন, হাদিস, দা‘ওয়াহ এবং ইসলামের ইতিহাসের বাইরে মাদরাসাগুলোতে অনার্স কোর্স নেই।

মাদরাসার কামিল ডিগ্রীকে মাস্টার্সের মান দেয়া হলেও তারা কলেজের ইসলামি শিক্ষার প্রভাষক হতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার কথাতো তারা ভাবতেই পারেন না। আবার মাদরাসার প্রশাসনিক পদে চাকরির যোগ্যতায় তারা নিষিদ্ধ। সরকারি প্রশাসনের উচুঁ স্তরে আবেদনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এটা মাদরাসার সাথে এক ধরনের প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষা একেবারেই বঞ্চিত। ডয়চে ভেলের তথ্যানুযায়ী দেশে দাখিল মাদরাসার সংখ্যা ৯,২২১টি। আলিম মাদরাসা ২,৬৮৮ টি। ফাজিল মাদরাসা ১,৩০০টি। আর কামিল মাদরাসা ১৯৪ টি। এগুলো এমপিওভুক্ত এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। দেশে প্রতি বছর নিয়ম অনুযায়ী বাজেট ঘোষিত হয়। বছর যায় বছর আসে। প্রতি বছর কম-বেশি বাজেট বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। এ বছর বাজেট ঘোষণার তারিখ ছিল ১১ জুন ২০২১। এটা ছিল দেশের ৪৯ তম বাজেট। দেশে দুই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। একটি হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাত। আরেকটি হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাখাত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। কিন্তু এখানে এবতেদায়ী মাদরাসার জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দাখিল-আলিম তথা মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র কোনো বাজেট নির্ধারণ করা হয়নি। শুধুমাত্র কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সাথে মাদরাসা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮,৩৪৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ বাজেটে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক খাতে বাজেট বেড়েছে ৫,৪০৭ সাত কোটি টাকা। বিপরীতে মাদরাসার জন্য বাজেট বেড়েছে মাত্র ৮৯৪ কোটি টাকা! সরকার স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত একটি শিক্ষা বাজেটের এই হাল সত্যি জাতির জন্য লজ্জার। এটা মাদরাসা শিক্ষার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। এত শত অপমান আর লাঞ্ছনার মাঝেও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বারবার। দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাদের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সম্প্রতি তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সেরা সাফল্য অর্জন করেছে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ১ম স্থানটি দখল করেছে মাদরাসা শিক্ষার্থী। ঢাবি অধিভূক্ত সাত কলেজের মেধা তালিকায়ও ১ম হয়েছে মাদরাসা শিক্ষার্থী। দেশে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পরীক্ষায় ১ম হয়েছে মাদরাসার ছাত্র। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইইনিটে ১ম স্থান অধিকার করেছে মাদরাসার শিক্ষার্থী। বুটেক্সে ১ম হয়েছে মাদরাসা শিক্ষার্থী। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) প্রথম হয়েছে মাদরাসা শিক্ষার্থী। হাজারো বিপত্তি, বাধা আর বঞ্চিত থাকার পরেও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এসব সাফল্য চোখে পড়ার মতো। এছাড়া বিগত এক যুগব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আকাশচুম্বী সাফল্য দেখিয়েছে। প্রথম স্থানসহ অনেক শীর্ষস্থান তারাই দখল করে আসছে। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় খ ইউনিটে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল একজন মাদরাসার ছাত্র। নাম তার আব্দুল খালেক। সেবছর প্রথম ১০ জনের ৪ জনই ছিলেন মাদরাসার শিক্ষার্থী। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল মাদরাসার শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম। দ্বিতীয় হয়েছিল আরেক মাদরাসার ছাত্র সেলিমুল কাদের। এছাড়া তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ স্থান অধিকারী ছিল মাদরাসা ছাত্র। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদরাসার ছাত্র এলিস জাহান। দ্বিতীয় হয় মাদরাসাছাত্র মিজানুল হক। চতুর্থ ও একাদশ স্থানটিও দখল করেছে ২ জন মাদরাসা ছাত্র। ২০১০-২০১১ সেশনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয় মাদরাসাছাত্র মাসরুর বিন আনসারী। ঘ ইউনিটে প্রথম হয় মাদরাসা ছাত্র আসাদুজ্জামান। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীও ছিল অন্য একজন মাদরাসার ছাত্র। এছাড়া খ ইউনিটে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ১৬তম, ১৭তম ও ১৮তম হয় মাদরাসা ছাত্র। ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় খ› ইউনিটে প্রথম হয় মাদরাসার ছাত্র আব্দুর রহমান মজুমদার। একই বছরে তিনি ঘ ইউনিটেও প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। উল্লেখ্য, মেধাতালিকায় ১০ জনের মধ্যে এ বছর মাদরাসার ছাত্র ছিল তিনজন। এভাবে আরো তথ্য-পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে দেখা যাবে, প্রতি শিক্ষাবর্ষেই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত ভালো করছে।

সাফল্য সত্ত্বেও একটি মাদরাসাকেও সরকারি করা হচ্ছে না। প্রতিবছর শতশত প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও মাদরাসাগুলো থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। প্রতিবছরই মাদরাসা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। এমনকি টপ ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই থাকে মাদরাসা থেকে আগত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। তাদেরকে ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনার সুযোগ দেয় না। মাদরাসায় পড়–য়া অর্ধকোটি জনশক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জাতীয় উন্নয়ন-সমৃদ্ধির কোনো টার্গেটেই পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। তাদেরকে অবহেলিত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এ বিশাল জনশক্তিকে তাই যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md Yeakub ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৯:৪৯ পিএম says : 0
Thanks for your excellent analysis and information.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন