মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

কুয়াকাটা ভাঙন রোধ প্রকল্প-প্রস্তাবটি আবারো ফেরত

কালক্ষেপন পারিহার করে দ্রুত ভাঙন রোধ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের তাগিদ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮:৫৮ এএম

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার প্রায় ১২ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ-এর ছোবল থেকে রক্ষায় ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকার ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ আরো কিছু পর্যবেক্ষন সহ ফেরত দিল পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়। বুধবার মন্ত্রনালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত এক সভায় একটি শিশু বিনোদন পার্ক এবং গঙ্গামতির চর ও জিরো পয়েন্টে দুটি সিকিউরিট স্টেশন সহ আরো কিছু বিষয় অন্তভর্’ক্ত করতে ডিপিটি ফেরত দিয়ে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতামত সহ দাখিল করতে বলেছেন। ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকার এ সংক্রান্ত ডিপিপি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল জোন হয়ে বোর্ডে প্রেরনের পরে তা অনুমোদন করে মন্ত্রনালয়ে পাঠান হয়েছিল গত অক্টোবরে ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের আঘাতে বিপর্যস্ত পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটকে রক্ষায় আগের ডিপিপি সংশোধন করে সাড়ে ৯শ কোটি থেকে ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। তবে তারও আগে মূল প্রকল্পব্যায় ধরা হয়েছিল ৬৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্প প্রস্তাবনায় আরো বেশ কয়েকটি বিষয় অন্তভর্’ক্ত করায় ব্যায় বৃদ্ধি পেয়ে ১২শ ৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছিল। সর্বশেষ পর্যবেক্ষন অনুযায়ী ডিপিপি’টি রিকাষ্ট করতে গিয়ে প্রকল্পব্যায় আরো ১ থেকে দুই কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল জোনের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার জানিয়েছেন, ‘আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সংশোধীত ডিপিপি বোর্ডে জমা দেব। বোর্ডের ডিজি এককভাবেই তা অনুমোদনের ক্ষমতা রাখেন এবং আশা করছি ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিবের কাছে তা উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। সচিব মহোদয় তা পরিপূর্ণ যাচাই বাছাই করে অনুমোদন করলে চলতি মাসের শেষে বা আগামী মাসে প্রথম সপ্তাহেই প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনে পেস হতে পারে’ বলেও জানান তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের ‘প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি’ ও ‘কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি’তে অনুমোদনের পরে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিশনের নির্বাহী কমিটি ‘একনেক’এর চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেস করার কথা। তবে সে পর্যন্ত পৌছতে কত সময় লাগবে তা এখনই বলতে পারেন নি দায়িত্বশীল মহল।
আগামী মার্চÑএপ্রিলের মধ্যে কুয়াকাটা ভাঙন রোধের প্রকল্প-প্রস্তাবটি নিয়ে একনেক-এর সবুজ সংকেত মিলতে পারে বলে আশা করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধীক দায়িত্বশীল মহল। ফলে চলতি অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ‘আরএডিপি’তে অন্তভর্’ক্তির সম্ভব না হলেও আগামী এডিপি’তে প্রকল্পটি অন্তভর্’ক্তির সম্ভবনা রয়েছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও পরিকল্পনা কমিশন আমলাতান্ত্রিক কালক্ষেপন কতটা পরিহার করে তার ওপর।
প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভ’মি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। যা সারা বিশে^ই অনেকটা বিরল। প্রতিদিন পটুয়াখালীর সর্ব দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর ও তার কোলের কুয়াকাটায় হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের এ বিরল দৃশ্য দেখতে। অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ পর্যটন কেন্দ্রে গত দুই দশকে পর্যটক আবাসন সুবিধা সহ নানামুখি উন্নয়ন হলেও একটি পরিপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাঁধা হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ভাঙন।
এমনকি ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কুয়াকাটার হলিডে হোমেসে পর্যটন মন্ত্রনালয়ের এক মূল্যায়ন সভায় আরো একটি মোটেল নির্মান ছাড়াও বৌদ্ধ মন্দির সংস্কার ও আধুনিকায়নে অর্থ বরাদ্ব সহ পর্যটন কেন্দ্রটিকে ‘একান্ত পর্যটন এলাকা’ হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন। এরআগে ১৯৯৬-এর জুনে এখানে পর্যটন করপোরেশনের প্রথম হলিডে হোমস-এর নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়।
কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রটির মুল অকর্ষন সী-বীচের পূর্বের রাবনাবাদ ও পশ্চিম প্রান্তের আন্ধারমানিক চ্যানেলের শ্রোত গতি পরিবর্তন করায় ঢেউ-এর আঘাতে ১৯৯৮ সাল থেকে এখানে বছরে এক মিটার করে সী বীচ বিলীন হতে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে তেমন কোন উদ্বেগ ছিলনা।
২০১০ সাল থেকে ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু উদ্যোগ গ্রহন করলেও তা টেকসই হয়নি। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবে কয়েক দফায় জিও টিউব, জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলে মূল সী বীচটি সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষায় কোট্ িকোটি টাকা ব্যায়ের পরেও কোন ইতিবাচক ফল হয়নি।
তবে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে গবেষনা প্রতিষ্ঠান ‘আইডব্লিউএম’ এবং নেদারল্যান্ডের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে এ লক্ষে ব্যাপক সমিক্ষা সম্পাদনের মাধ্যমে নকশা প্রনয়ন করেছে। আইডব্লিউএম-এর প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা উপক’লীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ থেকে সী বীচ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি গ্রোয়েনের মাধ্যমে ভাঙন রোধের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এলক্ষে মূল সী বীচ রক্ষায় দু প্রান্তের রাবনাবাদ ও আন্দামানিক চ্যানেল পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকায় সিসি ব্লকের সাহায্যে গ্রোয়েনগুলোতে জিও টেক্সটাইল-এর ওপর ৪৫ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার সাইজের সিসি ব্লক সন্নিবেশের মাধ্যমে ভাঙন রোধে আশাবাদী পানি উন্নয়ন বোর্ড।
প্রকল্পের আওতায় কুয়াকাটা সৈকতে ‘ওয়াকিং বে’ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ‘লাইফ গার্ড স্টেশন’, বসার স্থান, ট্রইল, পার্কিং ল্যান্ডস্কেপ ও টয়লেট নির্মানের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সাড়ে ৯শ কোটি টাকা ব্যায় সাপেক্ষ ডিপিপি’র ওপর কিছু পর্যবেক্ষন সহ পূণর্গঠনের নির্দেশ দেয়। সে আলোকে কুয়াকাটা ভাঙন রোধের পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রটিকে অকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প ব্যায়ও সাড়ে ৯শ কোটি থেকে ১ হাজার ২০৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছিল। এখন সেখানে আরো একটি শিশু বিনোদন কেন্দ্র ও সিকিউরিটি গার্ড স্টেশন নির্মানের নির্দেশ দিয়েছেন পানির সম্পদ সচিব।
ইতোমধ্যে পূণর্গঠনকৃত প্রকল্প-প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা সৈকত সংলগ্ন উপক’লীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ১২ কিলোমিটার বিটুমিনাস কার্পোটিং করে মেরিন ড্রাইভ রোডের আদলে সড়ক নির্মানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের ইকোপর্কের অভ্যন্তরে ৯শ মিটার ওয়াকিং সেল সহ ওয়াকওয়ে নির্মিত হবে ২.৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় গঙ্গামতির কাছে মেরিন ড্রাইভ রোডে দুটি নান্দনিক সেতুও নির্মিত হবে। যার একটি হবে ঝুলন্ত সেতু। অপরটি আরসিসি।
নেদারল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সহ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন তদরকি করবে দেশীয় আধা সরকারী গবেষনা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘আইডব্লিউএম’।
তবে বিভিন্ন মহল থেকে কুয়াকাটাকে বঙ্গোপসাগরের ছোবল থেকে রক্ষায় কালক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই বলে দাবী করে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। নচেত হতশ্রী কুয়াকাটার ক্ষত ক্রমে বাড়বে বলে জানিয়ে অদুর ভবিষতেই তা হয়ত নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে বলেও শংকা প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে এ পর্যটন কেন্দ্রটির প্রতি দেশী বিদেশী পর্যটকদের আগ্রহ ধরে রাখাও আর হয়ত সম্ভব নাও হতে পারে বলে মনে করছেন ট্যুর অপারেটরগন। অথচ কুয়াকাটা সহ পায়রা সমুদ্র বন্দরকে সারা দেশের সাথে সড়ক পথে সংযুক্ত করতেই অতি সম্প্রতি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে পায়রা সেতু নির্মিত হয়েছে।
ভাঙন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাবার আগেই কুয়াকাটাকে রক্ষায় বাস্তব উদ্যোগী হবার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীগনও। তবে সরকার কুয়াকাটায় ভাঙন রোধে সহ একটি নিরারপদ ও আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে খুবই আন্তরিক বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল জোনের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীও ইতোমধ্যে দু দফায় কুয়াকাটা সফর করে সরেজমিনে সে ধরনের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়ে সে আলোকেই কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন