শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সচেতনতা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

ভূমিকম্প শব্দটি দ্বারা যে কোন প্রকার ভূকম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায়, সেটা প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্যসৃষ্ট যাই হোক না কেন। বেশিরভাগ ভূমিকম্পের কারণ হল ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যূতি হওয়া। সেটা অন্যান্য কারণ, যেমন অগ্নুৎপাত, ভূমিধস, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থ নিউক্লিয়ার গবেষণায় ঘটানো আণবিক পরীক্ষা থেকেও হতে পারে। ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলকে বলে ফোকাস বা হাইপোসেন্টার। ভূঅভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই ভূমিকম্প।

ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দুর্বল হয় যে, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্পতরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যূতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ কি.মি.-এর মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে।

বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। আমাদের ভূপৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট-এর সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা থাকে ফল্ট বা ফাটল দ্বারা। প্লেটগুলোর নিচেই থাকে ভূঅভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ। কোনও প্রাকৃতিক কারণে এই গলিত পদার্থগুলোর স্থানচ্যূতি ঘটলে প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থানচ্যূতি ঘটে। এ কারণে একটি প্লেটের কোনও অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায়, যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের নিকট আবির্ভূত হয়। কখনো কখনো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হবার কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। কখনো পাহাড় কিংবা উঁচু স্থান থেকে বৃহৎ পরিসরে শিলাচ্যূতিজনিত কারণে ভূমিকম্প হতে পারে।

সরকারি তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে লক্ষাধিক লোক হতাহত হবে। দিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে কিছুটা কম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের ৩,২৬,০০০ ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২,০০০ ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫,০০০ ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অফ আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সিসেমিক ডিযাস্টার জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম।

যদিও ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষার কোনও গ্যারান্টি নেই, আগাম পরিকল্পনার সাথে সম্ভাব্য বিপদ চিহ্নিতকরণ জীবন বাঁচাতে পারে এবং আঘাত ও সম্পত্তির ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। ১. বাড়িতে সম্ভাব্য বিপদ পরীক্ষাকরণ। যেমন দেয়ালে সঠিকভাবে তাক লাগানো, বড় বা ভারী জিনিস নিচের তাকে রাখা, ব্রেকেবল আইটেম যেমন বোতলজাত খাবার, কাচপাত্র বন্ধ ক্যাবিনেটে সংরক্ষণ করা, ছবি এবং আয়নার মতো ভারি জিনিস বিছানা, সোফা এবং যেকোনো বসার জায়গা থেকে দূরে ঝুলিয়ে রাখা, ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুত ও গ্যাসসংযোগ মেরামত করা, সিলিং-এ কোনও গভীর ফাটল থাকলে মেরামত করা, কাঠামোগত ত্রুটি থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া এবং কীটনাশক এবং জ্বলনযোগ্য পণ্য নিচের তাক ও বদ্ধ ক্যাবিনেটে নিরাপদে সংরক্ষণ করা। ২. বাড়ির ভিতরে এবং বাইরে নিরাপদ স্থান সনাক্তকরন: ভারী ডেস্ক বা টেবিলের মতো আসবাবের নিচে, কোনও অভ্যন্তরীন প্রাচীরের বিপরীতে, যেখান থেকে জানালার কাঁচ, আয়না, ছবি ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বা ভারী বুককেস ও অন্যান্য ভারী আসবাব পড়ে যেতে পারে সেখান থেকে দূরে, ভবন, গাছ, টেলিফোন এবং বৈদ্যুতিক লাইন, ওভারপাসগুলো, এক্সপ্রেসওয়ে থেকে দূরে খোলা জায়গায়, এবং দেয়ালের খুটি ও বিম যা নিরাপদ জায়গা হিসাবে কাজ করতে পারে। ৩. নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের শিখানো: জরুরী ব্যবস্থাপনা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা, সম্পত্তি কীভাবে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করা যায় সেগুলো জানা, কীভাবে এবং কখন পুলিশ, বা ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এবং কোন রেডিও স্টেশনকে জরুরি তথ্যের জন্য ফোন করতে হবে তা বাচ্চাদের শিখানো এবং কীভাবে এবং কখন গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানি সংযোগ বন্ধ করতে হয় তা পরিবারের সকল সদস্যকে শিখানো। ৪. প্রয়োজনীয় উপকরণ কাছে রাখা: টর্চলাইট এবং অতিরিক্ত ব্যাটারি, পোর্টেবল ব্যাটারিচালিত রেডিও, প্রাথমিক চিকিৎসা কিট এবং ম্যানুয়্যাল, জরুরী খাবার ও পানি, কম্বল, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অর্থ। ৫. জরুরি যোগাযোগ পরিকল্পনা তৈরিকরণ: ভূমিকম্পের সময় পরিবারের সদস্যরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের পরে পুনরায় একত্রিত হওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করা, বাইরে থাকা কোনও আত্মীয় বা বন্ধুকে ‘পরিবারের যোগাযোগকেন্দ্র’ ব্যবহার করা, নিশ্চিত হওয়া যে পরিবারের প্রত্যেকে পরিচিত ব্যক্তিটির নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর জানে এবং ভূমিকম্পের সময় পরিবারের সদস্যরা পৃথক হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে পুনরায় একত্রিত হওয়ার জন্য একটি সুপরিচিত জায়গা নির্ধারন করে রাখা। ৬. এলাকার মানুষকে প্রস্তুত হতে সহায়তা করা: ভূমিকম্প সম্পর্কিত জরুরি তথ্য সহ স্থানীয় পত্রিকায় একটি বিশেষ বিভাগ প্রকাশ করা, স্থানীয় জরুরি পরিষেবা অফিস এবং হাসপাতালগুলির ফোন নম্বর মুদ্রণের মাধ্যমে তথ্যটি প্রচারকরণ, ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত সে সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করতে স্থানীয় জরুরি পরিষেবাগুলির সাথে কাজ করা, ভূমিকম্প ড্রিল পরিচালনা করার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান। ভূমিকম্পের সময় যতটা সম্ভব নিরাপদ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, কয়েকটি ভূমিকম্প আসলে একটি বৃহত্তর ভূমিকম্প হতে পারে। ভূমিকম্প বন্ধ হওয়া অবধি বাড়ির ভিতরে থাকতে হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রস্থান করতে হবে।

ঘরের ভিতরে থাকলে মাটিতে, টেবিল বা অন্যান্য শক্ত আসবাবের নিচে শুয়ে পড়া, কাছে যদি কোন টেবিল বা ডেস্ক না থাকে তবে মুখ এবং মাথা হাত দিয়ে ঢেকে রাখা, দরজা এবং দেয়ালের বাইরের অংশ এবং যেসব জিনিস ভেঙে পড়তে পারে, যেমন আলোকসজ্জা বা আসবাবপত্র থেকে দূরে থাকা, ভূমিকম্পের সময় মাথা বালিশ দিয়ে চেপে ধরে রক্ষা করা, যদি ভারী কোন কিছুর নিচে পড়ার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে নিকটস্থ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া, আশ্রয়ের জন্য একটি প্রবেশ দ্বার কেবল তখনই ব্যবহার করা যদি এটি কাছাকাছি থাকে এবং যদি এটি দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়, ভূমিকম্প বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভিতরে থাকা। গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশিরভাগ জখম ঘটে যখন ভবনের ভিতরে লোকেরা অন্য কোন জায়গায় চলে যেতে চায় বা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। নিশ্চিত হতে হবে বিদ্যুৎ চলে গেলেও স্প্রিংকলার সিস্টেম বা ফায়ার অ্যালার্ম যেন চালু হতে পাওে এবং লিফট ব্যবহার না করা।
ঘরের বাইরে থাকলে বিল্ডিং, স্ট্রিটলাইট এবং ইউটিলিটি তারের কাছ থেকে সরে যাওয়া, ভূমিকম্প বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত একেবারে খোলা জায়গায় অবস্থান করা, চলন্ত গাড়িতে থাকলে সুরক্ষার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থামে যাওয়া এবং গাড়ীতে থাকা, বিল্ডিং, গাছ, ওভারপাস এবং ইউটিলিটি তারের কাছাকাছি বা তার নিচে না থামা, ভূমিকম্প বন্ধ হয়ে গেলে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যাওয়া এবং ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা, সেতু এড়িয়ে চলা। ধ্বংসাবশেষের নিচে আটকা পড়লে ম্যাচ না জ্বালানো, রুমাল বা পোশাক দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা, পাইপ বা দেয়ালে আস্তে আস্তে শব্দ করা যাতে উদ্ধারকারীরা দ্রুত সনাক্ত করতে পারে অথবা যদি সাথে থাকে তবে হুইসেল ব্যবহার করা এবং শুধুমাত্র শেষ অবলম্বন হিসাবে চিৎকার করা, কারণ অতিরিক্ত চিৎকার শরীর ক্লান্ত করে দেয় এবং বিপজ্জনক পরিমাণে ধুলো নিঃশ্বাসের সাথে দেহের ভিতরে নিয়ে যেতে পারে।

ভূমিকম্পের পরে আঘাত আছে কিনা নিজেকে পরীক্ষা করা, আহত বা আটকা পড়া ব্যক্তিদের সহায়তা করা, গুরুতর আহত লোকদের যদি আরও আঘাতের আশঙ্কা না হয় তবে তাদের জোর করে সরানোর চেষ্টা না করা, ছোট অগ্নিকা-ের সন্ধান পেলে নিভিয়ে আগুনের বিপত্তি দূর করা, পেট্রল বা অন্যান্য জ্বলনীয় তরল তাৎক্ষণিকভাবে পরিষ্কার করা, সতর্কতার সাথে কক্ষ এবং দরজা খোলা। ভূমিকম্পের পরে আফটারশক বিল্ডিংয়ে আরও ক্ষতি করতে পারে। তাই আফটারশকস হওয়ার আগে বেরিয়ে আসা, প্রতিবেশীদের মধ্যে যাদের বিশেষ সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে তাদের সহায়তা করা, প্রবীণ ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া, জরুরি তথ্য এবং নির্দেশাবলীর জন্য পোর্টেবল ব্যাটারিচালিত রেডিও শোনা, ক্ষতিগ্রস্থ বিল্ডিংয়ের বাইরে থাকা, বীমা দাবির জন্য বাড়ির ক্ষয়-ক্ষতির ছবি তোলা সর্বোপরি সাবধানতার সাথে প্রতটি পদক্ষেপ নেয়া।

লেখক : সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন