মহিয়সী বেগম রোকেয়া রংপুরের পায়রাবন্দের জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জহির মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার উর্দুভাষী ছিলেন। তার দুই পুত্র খলিলুর রহমান আবু জায়গাম সাবের ও আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সাবের এবং দুই কন্যা করিমুন্নেসা খাতুন ও হোময়রা খাতুন রোকেয়া। পিতা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দু’পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, কন্যাদের জন্য গৃহে আরবি, ফার্সি ও উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। বেগম রোকেয়া পিতার দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে বড় ভাই খলিল সাবেরের কাছে ইংরেজি এবং বড় বোন করিমুন্নেসার নিকট বাংলা শিক্ষা লাভ করেন।
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের এক উচ্চশিক্ষিত, উদারমনস্ক পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হলে রোকেয়া সেখানেই চলে যান। রোকেয়ার মতো সৈয়দ সাখাওয়াতও চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি, নারী সমাজে শিক্ষা বিস্তার তথা নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি। বেগম রোকেয়ার বিবাহিত জীবন মাত্র ১৩ বছরের। সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হয় ১৯০৯ সালে। অকালেই তাঁদের দুটো কন্যা সন্তানেরও মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর সঞ্চিত টাকা থেকে স্ত্রী রোকেয়ার জন্য দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ভাগলপুরের বাড়িতেই রোকেয়া মাত্র ৫/৬ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল’ নামে মেয়েদের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে হাই স্কুলে পরিণত হয়। স্বামীর স্মৃতি ও উদ্দেশ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এ নামকরণ করা হয়। কিন্তু নানা কারণে একাকী তাঁর পক্ষে ভাগলপুরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে রোকেয়া কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
ইসলাম ধর্মে নারী সমাজের প্রতি উদারতা, ন্যায়বিচার এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। নারীর অধিকার রক্ষা, ধর্মচর্চা ও ধর্মাদশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কুরআনভিত্তিক সমাজে জ্ঞানার্জন নারী কিংবা পুরুষ কোনও এক সম্প্রদায়ের জন্য সীমিত থাকতে পারে না। ইসলামের শেষ পয়গম্বর প্রত্যেক নর-নারীর জন্য শিক্ষাকে অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এদেশে বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল মুসলমান সমাজকে। মুসলমান নারীর জীবন ব্যবস্থা এমনই করুণ দুর্বিষহ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, তাঁরা জানতেনই না ইসলাম কত মর্যাদাময় আসনে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ নিশ্চিদ্র অন্ধকারে এ দমবন্ধ পরিবেশে রোকেয়া এনেছিলেন খোলা হাওয়ার পরশ। কাঁপন ধরিয়েছিলেন অচলায়তনে। অচেতন নারীর মধ্যে অধিকারবোধ জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের শিক্ষার আলোকে অবগাহন করানোর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, আত্মমর্যাদা জাগরণের প্রেরণা হয়েছিলেন।
বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন, শতকরা ১০০ জন অশিক্ষিত মুসলিম নারীর মধ্যে জাগৃতি আনতে হলে এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা বিবেচনা করে দেখুন, হযরত মোহাম্পদ (সা.) তেরশত বৎসর পূর্বে শিক্ষার উপকারিতা সম্বন্ধে কী বলেছিলেন- ‘বিদ্যা শিক্ষা কর, যে বিদ্যা- শিক্ষা করে সে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হয়, যে বিদ্যা চর্চা করে সে আমার স্তব করে, যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে উপাসনা করে। ... বন্ধু সভায় বিদ্যা অলংকার স্বরূপ, শত্রু সম্পমুখে অস্ত্র স্বরূপ।’ ... যাঁহারা মোহা¤মদের (সা.) নামে প্রাণদানে প্রস্তুত হন, তারা তাঁর সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? ... কন্যাকে শিক্ষা দেওয়া আমাদের প্রিয় নবী ‘ফরজ’ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য’ বলিয়াছেন, তবু কেন তাঁহার কন্যারা শিক্ষায় উদাসীন?’ (মতিচুর ২য় খন্ড)।
সর্বক্ষেত্রেই রোকেয়া ছিলেন বিপ্লবী, সাহসী। বর্তমান শতাব্দীর শেষ সীমায় আমরা নারীকে কারখানা থেকে কৃষিক্ষেত্র পর্যন্ত কর্মরত দেখতে পাচ্ছি। রোকেয়া শুরুতেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুঃসাহসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। কোনও পারিবারিক আনুকূল্য রোকেয়া পাননি। কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ রোকেয়ার হয়নি। রোকেয়া নিজেই নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত রোকেয়া ছিলেন একাধিক ভাষায় সুপন্ডিত। কোন আগুনের পরশমণি এমন একটি প্রতিভার জন্ম দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যুগসন্ধির এক কঠিন সময়ে রোকেয়া কোনও সহযোগী ছাড়াই একা এদেশের নারী-জীবনে মুক্তির আলো আনার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রতিভা ছিল বহুমুখী। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা, কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থা, কুটির শিল্পের দূরাবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে তিনি সুচিন্তিত ও নিপুন আলোচনা করেছেন। তিনি একজন মহান মানুষ, আপোসহীন সংগ্রামী। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে সমাজে নারী শিক্ষার অনেকখানি প্রসার ঘটেছে। কিন্তু এতে সন্তুষ্টির অবকাশ নেই। কিন্তু অন্তঃপুরের, উঠোনে আজও ইসলাম ঘোষিত শিক্ষার আলোকে পৌঁছানো যায়নি। পৌঁছানো যায়নি কারণ, শিক্ষিত হলেও মুক্তবুদ্ধির চেতনা থেকে আজও আমরা বঞ্চিত।
শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ কুরআন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ভূলে যেতে বসেছে। আর যারা আজও শিক্ষা বঞ্চিত তাদের কাছে এ উন্নত মানসিকতা আশা করা যায় না। কারণ ইসলাম শিক্ষিতের ধর্ম, মূর্খ-অজ্ঞের ধর্ম নয়। আজও চতুর্দিকে দারুন হা-হুতাশ ইসলাম ধর্মের জন্য মুসলমান নারীর জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিয়ে বিখ্যাত হওয়া যাচ্ছে অতি সহজে। কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত গুণ মানুষের জানার আকাঙ্খা বাড়ায়, বুদ্ধির মুক্তি ঘটায়। বেগম রোকেয়া সে দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সঙ্কটের বিচার করতে পেরেছিলেন। সৌন্দর্য ও শালীনতাবোধ এবং জ্ঞানপিপাসা ইসলাম ধর্মের অঙ্গ। অশালীন ও উশৃংখল জীবনের ছাড়পত্র এখানে পাওয়া যায় না। বেগম রোকেয়া সৌন্দর্য ও শালীনতার একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন; সেই সঙ্গে ছিল তাঁর অপরিসীম সম্ভ্রমবোধ। একটি প্রবন্ধে তাই সরাসরি বলতে পেরেছেন, উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাঁরা প্রায়ই বোরখা ছাড়তে বলেন, বলি, উন্নতি জিনিষটা কি? তা কি কেবল বোরকার বাহিরে থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝবে যে, জেলেনী, চামারনী, কি ডুমনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের চেয়ে অধিক উন্নতি লাভ করেছেন। তিনি ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘আমরা অপ্রয়োজনীয় পর্দা রাখব?’ জীবন দর্শনের এ বলিষ্ঠ ভূমিকায় রোকেয়া ছিলেন আপোসহীন। পণ্য নয়, নারীকে বলিষ্ঠ মানুষের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর সাধনা। কিন্তু অবরোধ বন্দিনী নারী বহির্জীবনের মুক্ত প্রাঙ্গণে কি প্রকৃত অর্থে মুক্তি পেয়েছেন সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
বেগম রোকেয়া পর্দা প্রথার বিরোধী ছিলেন না- তবে গোড়ামির বিরোধী ছিলেন। তিনি উগ্র নারীবাদীদের মত বোরখা ছিঁড়ে ফেলে দেননি বরং তিনি সমাজের কথা চিন্তা করে বোরখা প্রথা মেনে চলতেন। কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে জাগিয়ে তোলা। তিনি ‘সওগাত’ সম্পাদককে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘আমি যে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ আছে। আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম-কানুনগুলোও মেনে চলছি। অবস্থা এরূপ এখন যে আমি পর্দার আড়ালে থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এটাও হয়তো দোষণীয় হয়ে পড়ছে। আমি বাড়িতে বাড়িতে ক্যানভাস করে মেয়ে আনতে যাই, কিন্তু অভিভাবকরা আমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেন, পর্দাপালন করা হয় কি না? অতটুকু ছোট মেয়ের বেলায়ও এ প্রশ্ন। এখন বুঝুন, কী পরিস্থিতির মাঝে স্কুল চালাচ্ছি, আর ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থাই বা কীরূপ? স্কুলের জন্য আমি সমাজের সকল অবিচার, অত্যাচার সহ্য করেছি।’ পর্দা প্রথা সম্বন্ধে ‘বোরখা’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘আমরা পর্দার অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই’। রোকেয়া কথাগুলো যে যুগে দাঁড়িয়ে বলেছেন সে যুগে নারীরা, বিশেষত মুসলিম নারীরা ছিলেন অন্তঃপুরচারিণী, অসূর্যমস্পর্শা। শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং ঘরের অভ্যন্তরীন কাজ চালানোই ছিল তাদের কাজ। কোনও, অভিযোগ কিংবা আকাঙ্খা ব্যক্ত করার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না তারা। তার ওপর ছিল যখন তখন ‘তালাক’-এর নির্মম আঘাত। এ তালাক প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনের শেষ প্রবন্ধ ‘নারীর অধিকার’ -এ লিখছেন, ‘আমাদের উত্তরবঙ্গে দেখেছি গৃহস্থ শ্রেণীর মধ্যে সর্বদা তালাক হয়, অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীকে সামান্য অপরাধে পরিত্যাগ করে। মেয়েটির কোনও ত্রুটি হলেই স্বামী দম্ভ করে প্রচার করে ‘আমি ওকে তালাক দেব, আজই দেব। এ রকম ঘটনা সব সময়ই ঘটত। এ সময়ে পুরুষটিকে খুব প্রফুল্ল দেখা যায়। বোধহয় নতুন পত্নী লাভ হবে তাই এ আনন্দে।’ যুগের সীমাবদ্ধতা সত্তে¦ও রোকেয়ার চিন্তাধারা কত আধুনিক ছিল তার প্রমাণ মেলে নারী সমাজের শৃঙ্খলিত হওয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজে বন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোনও অজ্ঞাত কারণবশত মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করতে লাগল, অপর অংশ (নারী) তার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করতে পারল না বলে পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিনী না হয়ে দাসি হয়ে পড়ল। আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলংকারগুলো এগুলো দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্য বর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মতে অলংকার দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ (Originally badges of slavery)। তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহ নির্মিত বেড়ি পরে, আমরাও স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ মল পরি। উহাদের হাতঘড়ী লৌহ নির্মিত, আমাদের হাতঘড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত চুড়ি। ... আমরা দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করেও আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করি- গর্বে স্ফিতা হই’ (মতিচুর-১)। এ প্রসঙ্গে এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘ব্যাপারটা অর্থাৎ নারীর শৃঙ্খলিত হওয়ার ঘটনা একদিনে ঘটেনি। উৎপাদন পদ্ধতি পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ চাষবাসের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবার ফলে প্রেমের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রাধান্য এসে গেল, এবং মেয়েদের সন্তান ধারণ করতে হয় বলে এ নতুন পরিস্থিতিতে প্রেমের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ল। ..ঘোষণা করল এবং নিজেদের আধিপত্য মেয়েদের ওপরে জোর করে চাপিয়ে দিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরুষ শাসিত সমাজের স্বার্থের অনুকূলে তাদের মানাবার জন্য নীতি-আদর্শ অনেক কিছুই আসতে থাকল এবং ধীরে ধীরে পুরুষ শাসিত সমাজের নীতি আদর্শ ইত্যাদিতে মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। ... কালক্রমে মেয়েরাও পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত হল। তারপর একদিন এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে গেল যে, আমরা দেখতে পাই মেয়েরা নিজেরাই স্ত্রী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলছে।’
বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হল মতিচুর (১ম ও ২য় খন্ড), পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী। সুলতানার স্বপ্ন তার বিখ্যাত রচনা। Sultana’s Dream এর অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের মাইলফলক বলা হয়। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ হল ‘বাসিফুল’ ‘শশধর’ ‘নলিনী ও কুমুদ’ ‘কাঞ্চনজঙ্খা’ ‘আপীল’ ‘চাঁদ’ ইত্যাদি। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে ‘পদ্মরাগ’ নামের একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন রোকেয়া। ষোলটি প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়। তার প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষার আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না, তা বলেছেন। ১৯১৬ সালে তিনি নারীদের সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামের নারী সমিতি গঠন করেন। তাঁর এ সমিতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। সমাজের উঁচু তলার, লেডি ফারুকি, লেডি অবলা বসু যেমন এ সংগঠনের সদস্য ছিলেন তেমনি সমাজের অবহেলিত অশিক্ষিত নারীরাও ছিলেন।
শতাব্দী পার হলেও বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন আজও নারী জীবনে এক অবিসংবাদী, প্রেরণাদায়ী সত্তা। তাঁর জীবনদর্শনে কোনও মোড়ক ছিল না, ছিল না কোনও লোক প্রদর্শনকারী উপাধি। তাঁর জীবনাদর্শ ছিল একান্ত সহজাত, আন্তরিক। কথায় ও কাজে তাঁর কোন ফারাক ছিল না। তাঁর চিন্তা, মন ও জীবন-যাপন ছিল এক সূত্রে গ্রন্থিবদ্ধ। সেজন্যই বেগম রোকেয়ার জীবনাদর্শন সর্বকালে বরেণ্য- কালোত্তীর্ণ তিনি।
বাংলার নারীজাগরণের এ প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা বেগম রোকেয়ার জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার। ৮ ডিসেম্বর রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি নিমগ্ন ছিলেন লেখা-পড়ায়। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। বাংলার নারী জাগরণের এ অনুপম ব্যক্তিত্বের মরদেহ কলকাতার কাছেই সোদপুর রেল ষ্টেশনের অনতিদূরে সুখচরের এক ক্ষুদ্র মুসলিম কবরস্থানে নামচিহ্নহীন কবরে চরম অবহেলায় শায়িত। দেশের জনসাধারণ দূরের কথা এ খবর কি রাখে তাঁর রক্ত দিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠানের আলোকিত শিক্ষার্থীনীরা! ইহজীবনে জাগতিক সব অবহেলাকে হেলায় জয় করেছিলেন রোকেয়া। মৃত্যুতেও আপন সৃষ্টির মাঝে তিনি অমলিন। রোকেয়ার মৃত্যুর পর ১১ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন এক শোকবার্তায় তাঁকে pioneer of higher education among Muslim girls in this province বলে আখ্যায়িত করেন।
বেগম রোকেয়া স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। বাংলাদেশে ৭ম বিভাগ রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। এছাড়াও মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন