শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

‘মরলে ৩ লাখ, বাঁচলে ১ লাখ’

গারো পহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবন মরণ সমস্যা!

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ পিএম

মরলে ৩ লাখ, বাঁচলে ১ লাখ! না, এমনইতে মরলে নয়। গারো পাহাড়ে বন্য হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে সরকার বন বিভাগের মাধ্যমে দেবে ৩ লাখ, আহত হলে ১ লাখ আর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেবে ৫০ হাজার টাকা। এ ঘোষনা দেয়া হয়েছে গত মঙ্গঁলবার সরকারের বন বিভাগের মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে সীমান্তবর্তী শেরপুরের গারো পাহাড়ি অঞ্চল ঝিনাইগাতী. শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি উপজেলায় ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর চলছে হাতি-মানুষের যুদ্ধ। গারো পাহাড়ের প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার এলাকায় বছরের পর বছর চলছে বন্য হাতির অব্যাহত তান্ডব। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ফি-বছর বন্য হাতি খেয়ে ও পায়ে পিষে সাবার করছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ জমির ফসল, ধ্বংস করছে বসতবাড়ি, খেয়ে সাবার করছে বাড়ির গোলার ধান। বন্য হাতির পাল পাহাড়ি অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আসছে লাগাতার ভাবে। ভেঙে তছনছ করে, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে তাদের খেতের ফসল বসতবাড়ি। দীর্ঘ ২৭ বছর অব্যাহত চলে আসছে এ অবস্থা। জানা যায়, এতে হাতির পায়ে পৃষ্ঠ হয়ে মারা গেছে ৫৮ জন পাহাড়ি ভাগ্যাহত মানুষ, আহত হয়েছে ৫ শতাধিক। পঙগুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক মানুষ। হাতি মরেছে ৩১ টি। মোট কথা বন্য হাতি গারো পাহাড়ের মানুষের জীবন মরণ সমস্যা হলেও অবসান হচ্ছেনা হাতি-মানুষের যুদ্ধ! কবে অবসান হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। প্রসঙ্গঁত. ফি-বছর ধান পাকার মৌসুমে ধান ও সবজি এবং আম-কাঁঠালের মৌসুমে আম-কাঁঠাল খওয়র নেশায় হাতির পাল নেমে আসে লোকালয়ে। চালায় তান্ডবলীলা। পাহাড়ি মানুষ ফসল ও বাড়িঘর রক্ষার্থে হাতি তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠে। শুরু হয় হাতি-মানুষের যুদ্ধ! অব্যাহত যুদ্ধে কখন কার প্রাণ যায় তা বলা কঠিন। অপর দিকে বন্য হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে ৩ লাখ টাকা, আহত হলে ১ লাখ ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৫০ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন সরকার। অত্যাচার থামাতে ইতোপূর্বে স্থাপন করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎচালিত তারের বেষ্টনী (ফেন্সিং), হাতির জন্য খাদ্যের বাগান তৈরিসহ হাতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলে একের পর এক করা হচ্ছে বন বিভাগের মাধ্যমে জনসচেতনামূলক সভা। কিন্তু কোন অবস্থাতেই বন্য হাতির বেপরোয়া আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাচ্ছেনা।
জানা যায়, পাহাড়ি অঞ্চলের শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গারো পাহাড়ে হাতির আবাসস্থল তৎকালিন অসাধু বন কর্মকর্তা কর্মচারিদের যোগশাজসেই নগতনারায়ণের বিনিময়েই দরিদ্র লোকজন দখলে নিয়েছে এবং বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। তাদের সাথে টাকার বিনিময়ে অলিখিত চুক্তিতে বাড়িঘর নির্মাণ, গাছপালা নিধন ও পাহাড় কেটে বন্ধ করে দিয়েছে হাতি ও জীব-জন্তুু, জানোয়রের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র। এ অবস্থা এক দুই দিনে হয়নি। আর এর জন্য বন বিভাগই বহুলাংশে দায়ী বলে জানা যায়। অথচ এককালে পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে ঝোঁপ-ঝাড়, ঘন-গহীন বন জঙ্গঁল সমৃদ্ধ ছিল। তখন শুধু হাতি নয় কোন বন্য জীব-জন্তুু, জানোয়ারই লোকালয়ে আসেনি।
এখন পাহাড়ের সমতল ভূমিতে আবাদ করা আমন-বোরো, শাক-সবজি ও ফলমূলের খেতে নিয়মিতই নেমে আসছে হাতির পাল। এসবতো ধ্বংস করছেই, খেয়ে সাবার করছে বাড়ির গোলার ধান। এজন্য অনেকেই আবাদ ছেড়ে দেয়ায় পতিত পড়ে রয়েছে বহু রেকর্ডিয় আবাদি জমি দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে। ভারতীয় হাতি পাহাড়ি ঝর্ণা, নদীর পাড় বেয়ে এবং ব্রিজের নিচ দিয়ে পাকা ফসলের মাঠে নেমে আসছে। কখনো বা ওপাড়ে অত্যাচার বেড়ে গেলে তাড়া দিয়ে এ পাড়ে ঠেলে দেয়া হয় হাতির পাল। আশির দশকের পর থেকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। হারিয়ে যায় অনেক বন্যপ্রাণী। তবে অব্যাহত থাকে বন্য হাতির তান্ডব।
বন বিভাগের পক্ষ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা থেকে ছোট গজনী, হালচাটি এলাকা পর্যন্ত স্থাপন করা হয় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেন্সিং। তাওয়াকুচা ও কর্ণঝোরা এলাকার ৫০ হেক্টর জমিতে তৈরি করা হয় হাতির খাদ্যের বাগান। রাংটিয়া, গোপালপুর বিটে রোপণ করা হয় কাঁটাযুক্ত গাছ। এতে কিছু সুফল মিললেও মানুষের অসচেতনতা ও সংস্কারের অভাবে সবই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বন বিভাগ জানায়, দিনের বেলায় সোলার ফেন্সিং বন্ধ থাকার কারণে এলাকাবাসী ফেন্সিং ঢিলা করে পাহাড়ে গরু চড়াতে যায় এবং লোকজনের যাতায়াতও বেড়েছে। সংস্কারের অভাবে সোলার ফেন্সিং অকার্যকর হয়ে পড়েছে। হাতির জন্য খাদ্যের বাগান এখন নেই বললেই চলে। ফলে হাতি খাবার না পেয়ে খাদ্যের সন্ধাণে লোকালয়ে ঢুকে চালাচ্ছে তান্ডব। তবে ধান কাঁঠালের প্রতি হাতি ব্যাপক দুর্বল। তাছাড়া হাতি কখনও এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করে না। আজ এখানেতো কালই অন্য খানে ছুটে যায়, এভাবেই চষে বেড়ায় গোটা পাহাড়ি অঞ্চল। তাই হাতি ও মানুষের সহাবস্থান তৈরির ব্যরস্থা করা জরুরী বলে অভিঙ্গঁমহল মণে করেন।
এলাকার প্রবিণ ব্যাক্তিত্ব শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী, আলহাজ, শরীফ উদ্দিন সরকার, আলহাজ, রেজাউর রহমান ম্স্টার, সরোয়ারর্দী দুদু মন্ডল প্রমূখ বলেন, একটি হাতির প্রতিদিন গড়ে ২০০ কেজি খাবার প্রয়োজন। পাহাড়ের ফলমূল, লতাগুল্ম, কলাগাছ ইত্যাদি হাতির প্রধান খাদ্য। বর্তমানে পাহাড়ে এসব খাদ্যের চরম সংকট চলছে। তাই খাদ্যের সন্ধানে হাতির পাল অব্যাহতভাবেই লোকালয়ে নেমে আসছে এবং খেতের ফসল খেয়ে সাবার করছে, ভাংছে বাড়িঘর খাচ্ছে গোলার ধান ও চালচ্ছে তান্ডব লীলা। খেতের ফসল ও বাড়িঘর রক্ষার্থে লোকজন হাতি তাড়াতে গিয়ে বিঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে না হাতির তান্ডব লীলা ও রক্ষা পাচ্ছেনা পাহাড়ি অঞ্চলের দরিদ্র মুসলমানসহ গারো, হাজং, কোঁচ জনগোষ্ঠি।
এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির বলেন পাহাড়ের মানুষ এমনিতেই অতি দরিদ্র। তাদের কষ্টার্জিত ফসল অব্যাহতভাবে হাতি খেয়ে সাবার করায় কৃষকরা অতিকষ্টে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানুষ ও যাতে না মরে, হাতিও যাতে না মরে তার ব্যবস্থা করা দরকার।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও ) মো. ফারুক আল মাসুদ বলেন, সরকার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি গারো পাহাড়ে হাতি চলাচলের জন্য অভয়াশ্রম করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে হাতির উপদ্রব কমে যাবে বলে আশা করছি। তবে সতর্কতা আবশ্যক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন