এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে বাঙালি জাতি উন্নয়ন যাত্রাপথে সাফল্য অর্জনের কঠোর সংগ্রামে অবিচল থাকতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক যখন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ^খ্যাত সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেনরি কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাতে বাংলাদেশ এর ফলে বৈদেশিক অনুদান, খাদ্য সহায়তা এবং ‘সফট লোন’ পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা পায়। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশকে ঐ অপমানজনক অবস্থান থেকে বের করে আনবেন। কিন্তু, এর পর দীর্ঘ সময় লেগে গেছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সোপানে পৌঁছানোর জন্য। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এবং ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিম্নলিখিত ডাইমেনশনগুলো বিশ্বে বহুল প্রশংসিত:
১। বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাত সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থ-বছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২১ সালের ৩০ জুন ২৫৫৪ ডলারে পৌঁছেছে (জিএনআই বেশ কিছুটা বেড়েছে ভিত্তি বছর পরিবর্তনের ফলে)। আইএমএফ এর মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে ২০১৫ সালেই।
২। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল, যেখান থেকে ২০২০ সালের মার্চে করোনা ভাইরাস মহামারির তান্ডব শুরু হওয়ার পর্যায়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০.৫ শতাংশে নেমে গেছে। (গত দেড় বছরে মহামারির কারণে দারিদ্র্য আবার ৫-১০ শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)।
৩। ১৯৭৬-৭৭ অর্থ-বছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান ১০ শতাংশের বেশি ছিল, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে জিডিপি’র এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর দেশ নয়, একটি বাণিজ্য-নির্ভর দেশ। এক দশক ধরে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে, বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতিও এখন আর সংকটজনক নয়।
৪। জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েেেছ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বিরাশি লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি তিপ্পান্ন লাখ টন। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও মাংস উৎপাদনে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা যাবে বলে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং মাঝে মাঝে কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত থাকছে। ছাগল উৎপাদনে আমরা উদ্বৃত্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছি। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও এখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে, যদিও বিদেশ থেকে নানারকম বিদেশি ফল আমদানি ক্রমেই বাড়ছে। আমরা প্রতি বছর প্রায় ৫৫/৬০ লাখ টন গমও আমদানি করি। তবুও এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।
৫। করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে শিল্পখাতের অবদান জিডিপির ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাতও ৩১.৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার। (করোনা মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল, কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ-বছরে তা আবার ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে)। রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসছে বুনন ও বয়নকৃত তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয়-বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৬। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। করোনা মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পথে (formal channels) রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের চাইতে ২৪ শতাংশ বেড়ে ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
৭। ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর অনুপাতের ঋণগ্রহীতা সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্র ঋণকে এদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠিগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটি বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
৮। বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
৯। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের শেষে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। (গত চার মাসে রিজার্ভ আবার ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।) বাংলাদেশের এক টাকায় এখন পাকিস্তানের দুই রুপি পাওয়া যায়, অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি রুপির বৈদেশিক মান বাংলাদেশের টাকার চাইতে বেশি ছিল। ভারতের রুপির বৈদেশিক মানের তুলনায়ও বাংলাদেশের টাকার মান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১০। বাংলাদেশে এখন সাড়ে ষোল কোটি মোবাইল টেলিফোন রয়েছে, এগার কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিশ^ ব্যাংক, দাতা দেশ ও অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোর ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ সুপারিশমালা অগ্রাহ্য করে কৃষি ও কৃষক-বান্ধব নীতিমালা গ্রহণের কারণেই কৃষিখাতে এই চমকপ্রদ সাফল্যের ধারা সূচিত হয়েছিল এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ দীর্ঘ ৪২ বছর পর ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ঐ কৃষি নীতিমালা পরিত্যাগ করে আবারো বিশ্ব ব্যাংক ও দাতা দেশগুলোর ডিকটেশান অনুসরণের পুরানো পথে ফিরে যায়। ২০০৭ সালে তাদের ভুল নীতি দেশে একটা চরম খাদ্য মজুত-ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং খাদ্যশস্যের বাজারে একটা ‘প্যানিক-বাইয়িং’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগতো আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন। গত বছর এদেশে তিন কোটি বিরাশি লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। সতের কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য যোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতি বছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। খাদ্যসাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আল্লাহর রহমতে খাদ্যসাহায্যের মরণচক্র থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছেন এদেশের কৃষক সমাজ। কৃষিখাতের সমৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ বদলে ফেলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
দেশের কৃষি ব্যবস্থা (agrarian system) স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছরে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ, প্রান্তিকীকরণ (marginalization) এবং নিঃস্বকরণ (pauperization) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেকখানি রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রধান প্রধান প্রক্রিয়াগুলো হলো: ক) জমির মালিকানা ও কৃষি-জোতের (operational holding) ক্রমহ্রাসমান সাইজ, খ) জমির সাইজের প্রান্তিকীকরণ ও ভূমিহীন গ্রামীণ পরিবারের অনুপাতবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, গ) ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শহুরে অনুপস্থিত ভূমি মালিক পেশাজীবী ও প্রবাসী মালিকদের কাছে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে জমির মালিকানার পুঞ্জীভবনের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ভূমি মালিকদের ভূমিহীন কৃষক, বর্গাদার ও খেতমজুরে পরিণত হওয়ার হারবৃদ্ধি, ঘ) বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমির মালিকানার খন্ডিতকরণ ও প্রান্তিকীকরণ, ঙ) মাঝারী ও ছোট ভূমি মালিক-কৃষকদের অনুপাতের দ্রুত হ্রাস এবং এর ফলে বর্গাদারি ও ভাগচাষের ব্যাপক অনুপাতবৃদ্ধি, চ) একই জোতে অন্তর্ভুক্ত জমির খন্ড-বিখন্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থানে ছড়িয়ে থাকা এবং এর ফলে চাষের প্লটের সাইজ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হওয়ার প্রবণতা, ছ) ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় বর্গাদারি ও ইজারাদারির দ্রুত প্রবৃদ্ধি, যেখানে ক্ষুদ্র ভূমি মালিক-কৃষক কর্তৃক নিজেদের মালিকানাধীন জমির সাথে অনুপস্থিত ভূমি মালিকদের জমি বর্গা নিয়ে চাষের জোতকে ‘অর্থনৈতিক জোতে’ পরিণত করার প্রবণতাই প্রধানত ক্রিয়াশীল, জ) কৃষিজাতপণ্য বাজারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের অব্যাহত আধিপত্য, ঝ) কৃষি-উপকরণ যোগান ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বাজারিকরণ, যেখানে ক্ষমতাশীল দল বা জোটের নেতা-কর্মীদের মুনাফাবাজির তান্ডব এবং চাঁদাবাজ ও মাস্তানদের উপদ্রব কৃষকদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে, ঞ) প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারী কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা সমস্যা ও মহাজনী ঋণের অব্যাহত দাপট, ট) কৃষিতে মৌসুমী বেকারত্ব ও ছদ্ম বেকারত্ব সমস্যার অব্যাহত প্রাদুর্ভাব, ঠ) প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসলহানি, ড) ব্যয়বহুল বিয়ে, যৌতুক, বিদেশে অভিবাসন-ব্যয় মেটানো এবং মারাত্মক অসুস্থতার কারণে জমি বিক্রয়, ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত নেতিবাচক প্রক্রিয়াগুলোর বিপরীতে কৃষিখাতে অনেকগুলো ইতিবাচক পরিবর্তনও সূচিত হয়েছে, যার মধ্যে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, কৃষিখাতে যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারী, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, আধুনিক রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ফলে কৃষি ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রবণতাগুলোকে ছাপিয়ে উৎপাদনশীলতার উল্লম্ফন দেশে একটি কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছে। এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, দেশের জিডিপির মাত্র ১৪ শতাংশ এখন কৃষিখাত থেকে আসছে। অবশ্য, কৃষিতে এখনো দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ কর্মরত রয়েছেন।
উপরন্তু, বাংলাদেশের অভিবাসী বিশে^র নানা দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রতি বছর যে ১৭/১৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ চ্যানেলে আরো আট-দশ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ অর্থনীতির জন্যে সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিবাসীর নব্বই শতাংশ যেহেতু গ্রামীণ জনপদের অভিবাসী, তাই এই বিশাল রেমিট্যান্স প্রবাহের সুফলের সিংহভাগও গ্রামের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করে চলেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য দ্রুত নিরসনের বড় কারণ এই রেমিট্যান্স প্রবাহ। রেমিট্যান্স প্রবাহের সুফলভোগী পরিবারগুলোর বর্ধিত ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড়সড় সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর পাকা হচ্ছে, অন্যান্য ধরনের বসতঘরেরও মান বৃদ্ধি পেয়েছে, ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পরিবারের সদস্যদের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সামর্থ্য বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে, সেনিটারি পায়খানার প্রচলন বাড়ছে, ঘরে ঘরে টিউবওয়েল বসে গেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ তরান্বিত হচ্ছে, গ্রামের রাস্তাঘাটেও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে, সর্বোপরি গ্রামের নারী সমাজের ক্ষমতায়নের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে, গ্রামীণ জনগণের মধ্যে প্রায় আশি লাখ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৪-৫ কোটি মানুষ এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অবস্থানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কৃষিখাতের সাফল্যের পেছনেও বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) প্রযুক্তির প্রসার, সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, গ্রামীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, আধুনিক স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণের পারঙ্গমতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বিপুল অবদান রাখছে।
অন্যদিকে, জমিজমার অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি, স্থানীয় মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, অ-প্রবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে ভূমিহীনতা বৃদ্ধি এবং ভূমি মালিকানার প্রান্তিকীকরণ বৃদ্ধি, বর্গাদারি বৃদ্ধি, অনুপস্থিত ভূমি মালিকদের কাছে জমির মালিকানার পুঞ্জীভবন- এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাবও সৃষ্টি করে চলেছে অভিবাসন প্রক্রিয়া। ভূমি মালিক-কৃষক কর্তৃক পরিচালিত মাঝারী ও ক্ষুদ্র কৃষি জোতের অনুপাত এখন অভিবাসন-প্রভাবিত গ্রামগুলোতে দ্রুত কমছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পরিযায়ী ক্ষেতমজুর ও বর্গাদার কৃষক এখন এ ধরনের গ্রামগুলোর কৃষিতে ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে ওঠার ফলে চাষাবাদের খরচ দ্রুত বেড়ে শস্য উৎপাদনকে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক করে ফেলছে। কৃষি উপকরণের বাজারে এবং কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া ক্রমশ অনুপ্রবেশ করছে। কৃষিঋণের বাজার ব্যবস্থায় ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহকারী গ্রামীণ ব্যাংক ও এনজিওগুলোর ভূমিকা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকগুলোর চাইতে অনেক বেশি জোরদার হয়ে চলেছে। ফলে, কৃষকরা মহাজনী ঋণের শোষণ প্রক্রিয়া থেকে অনেকখানি মুক্তি পেলেও এনজিও ঋণের ফাঁদের আরেকটি দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছে। কৃষকের ঋণগ্রস্ততা সমস্যার ভালো সুরাহা হয়েছে বলা যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা এখনো তাদের ফসলের ন্যায্যদাম পাচ্ছেন না, বাম্পার ফসল হলে প্রায় প্রতি বছর ফসলের দামে ধস নামার পুরানো সমস্যার ভালো সমাধান এখনো আমরা পাইনি। কৃষিতে নারীর অবদান বাংলাদেশে এখনো একটি অবহেলিত বিষয়। কৃষি ব্যবস্থা এদেশে যেহেতু প্রধানত পারিবারিক উৎপাদন ও ভোগকেন্দ্রিক ‘কিষাণ উৎপাদন পদ্ধতির’ অধীনে রয়ে গেছে তাই নারীশ্রম এই ব্যবস্থার প্রাণভোমরা হলেও পুরুষ-আধিপত্যাধীন সমাজের পরিবারে নারী এখনো অধঃস্তন অবস্থানের আপেক্ষিক মর্যাদাহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। তবুও ধীরে ধীরে যে নারী শোষণের যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসছে সেটা বোঝা যায়।
উপরে অর্থনীতির সামষ্টিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ জনসমাজের যে পরিবর্তনগুলো বর্ণনা করা হলো তার পাশাপাশি এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য জিনি (বা গিনি) সহগ সবচেয়ে বহুলব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন ঐ দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩৩, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। এই ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের প্রত্যক্ষ শিকার গ্রামীণ জনগণ। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো শহরে-নগরে এবং প্রধানত রাজধানীতে বসবাস করা এবং সম্ভব হলে ধন-সম্পদ নিয়ে উন্নত বিশ্বে চলে যাওয়া। বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও দেশ থেকে বিদেশে দেদারসে পুঁজি পাচার করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি-ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের (মানে ২৫৮ কোটি টাকার) বেশি সম্পদের মালিক অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। দেশের আয় এবং সম্পদের এহেন পুঞ্জীভবন বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছেই দেশের খেলাপি ব্যাংকঋণের ৮০ শতাংশেরও বেশি আটকে রয়েছে এবং এই ব্যাংকঋণ লুটেরারা ঋণের সিংহভাগ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। টরোন্টোর ‘বেগম পাড়া’ এবং মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমের’ বাসিন্দাদের সিংহভাগই এদেশের রাঘববোয়াল পুঁজি পাচারকারী। বাংলাদেশের এই পুঁজি পাচারকারীরা জাতির শত্রু। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাব মোতাবেক, গত এক দশক ধরে প্রতি বছর দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার হয়ে চলেছে গড়ে ৭-৯ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এখনো এদেশের গ্রামীণ জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা, যাতনা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সরকারের সকল স্তরের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত তিন বছরে এই অঙ্গীকার পূরণকে সত্যিকার অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না। গ্রামীণ জনগণের জীবনের আরেকটি বিভীষিকার নাম শাসকদলের নেতা-কর্মীদের মাস্তানি ও গুন্ডামি। দিনদিন যে এহেন অত্যাচার বেড়েই চলেছে সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? দেশ থেকে নির্বাচনী রাজনীতি নির্বাসিত হয়ে গেছে। দেশে অদূর ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে কিনা সে সম্পর্কে জনমনে সর্বনাশা আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে এবার যে সন্ত্রাস, খুনোখুনি, মাস্তানি ও জালিয়াতি পরিদৃষ্ট হচ্ছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা চলে, অর্থনৈতিক অভাব-অনটন বেশ খানিকটা কমে গেলেও বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ তেমন ভালো নেই।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন