শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা প্রশ্ন

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

হঠাৎ করে গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র দেশের র‌্যাব এবং তার বর্তমান ও প্রাক্তন ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর আগে কখনো বাংলাদেশের কোনো সংস্থা বা বাহিনীর কর্মকর্তাক এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়নি। এ নিষেধাজ্ঞায় দেশের ভাবমর্যাদায় ক্ষুন্ন হয়েছে। মার্কিন অর্থ দফতরের ‘ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস’ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা ও ৬০০ জনকে গুম করার অভিযোগ রয়েছে। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কোনো সম্পদ থাকলে তা বাজেয়াপ্তও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাটি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। বিষয়টি সর্বাধিক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। উপরন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। কিছু এনজিও এবং হিউম্যান রাইটস গ্রæপ নাকি অভিযোগ করেছে। আমেরিকাতে প্রতি বছর ছয় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। কিন্তু সেজন্য সেখানকার কোনো হেড অফ অথরিটির শাস্তি হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে কেউ ইচ্ছে করে ক্রসফায়ার বা গুলি করতে পারে না। এসব ঘটনার পেছনে যথাযথ কারণ ছিলো। তথ্যমন্ত্রী বলেন, যেভাবে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেটি অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। কোনো যোগাযোগ ছাড়াই হঠাৎ করে এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হয়েছে।তবে, এই ঘটনা দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। সেতুমন্ত্রী বলেন, মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত একপেশে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, র‌্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই। অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ বিষয়ে বলেছেন, দীর্ঘদিন যাবত র‌্যাবের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের কথা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছিল। উপরন্তু গত বছর অক্টোবর মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে সিনেটের আটজন সদস্য চিঠি দিয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে কিছু সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছিলেন। তারই ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। এরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন। আর র‌্যাবও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলো বাতিল হতে পারে। অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পেছনে চীন ও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক, কোয়াডে যোগ দিতে বাংলাদেশের অস্বীকৃতি- এমন নানা কারণে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলের একটি যোগসাজশ রয়েছে।

যা’হোক, যুক্তরাষ্ট্রের উক্ত নিষেধাজ্ঞা জারির পূর্বদিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গুমের ৮৬টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এসব গুমের শিকার হওয়া মানুষদের হদিস স্বজনদের জানাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই বিষয়ে একটি স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক তদন্তেরও দাবি করেছে। এসব ঘটনায় জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং পুনরাবৃত্তি বন্ধে জাতিসংঘের কর্মকর্তা, দাতা সংস্থা ও ব্যবসায়িক অংশীদারদেরও পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্য যে-কোনো বাহিনীর চেয়ে গুমের ঘটনায় র‌্যাবের দায় সবচেয়ে বেশি। তাই জাতিসংঘ মহাসচিবের উচিত অনতিবিলম্বে র‌্যাব কর্মকর্তাদের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা। র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরদিন ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজকে তাদের দেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে তার মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয়েছে। আল জাজিরায় জেনারেল আজিজের দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের খবর প্রচারের পর যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।

অবশ্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন নয়। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই এই অভিযোগ হয়ে আসছে এবং তা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রবলতর হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান সরকারের কুক্ষিগত হয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে অনুগত লোকদের। তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। কোনো কিছুরই জবাবদিহি নেই কোথাও। ফলে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়াসহ সব অপরাধ ব্যাপকতর হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য দেশ-বিদেশের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন বারবার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান নিচে দেখানো হয়েছে। উপরন্তু কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাইব্রিড গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী সরকার ইত্যাদি। তবুও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং ক্রমাবনতি হয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা মানবন্ধন করেছেন, তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে জানতে চেয়েছেন, যাতে তারা গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কিছু ফেরত এসেছে। কিন্তু তাদের কেউই মুখ খোলেনি। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বিবিসিকে বলেছেন, গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে চেষ্টা করেও তথ্য পাওয়া যায়নি। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চলছে। আমরা স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে আসছি। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কখনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে আজকে আমরা এই জিনিসটা দেখলাম। এখন তো তারা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করছে, পরে হয়ত তারা রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করতে পারে। তাই তার আগেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে মানবাধিকার, যেখানেই লঙ্ঘন সেখানেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের উদ্যোগে গৃহীত শপথ বিশ্বব্যাপী একনায়কতন্ত্রকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য কাজ করবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মানবাধিকার রক্ষায়ও একসঙ্গে কাজ করবে এসব রাষ্ট্র। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশের র‌্যাবের ন্যায় চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়াসহ ৮ দেশের বেশ কয়েকজন নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে ঐকমত্য পোষণ করেছে কানাডা ও যুক্তরাজ্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈরী আচরণ কি শুধু গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণেই হয়েছে? নাকি বিশ্বের নতুন মেরুকরণের ক্ষেত্রে সঙ্গী হিসেবে না পেয়ে হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উদয় হয়েছে। কারণ, বিশ্বে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিকে এর নেতৃত্বে রয়েছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা অন্যদিকে আছে চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে তাদের মিত্ররা। উভয় জোটই স্বীয় বলয় শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। এই স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে খেলাধুলায়ও। চীনে অনুষ্ঠিত চলতি শীতকালীন অলিম্পিক বর্জন করেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সৃষ্ট দ্ব›েদ্ব আমেরিকা, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও জি-৭ কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়েছে রাশিয়াকে। যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অস্ত্র দিয়েছে ইউক্রেনকে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক গণতন্ত্র সম্মেলনে চীন ও রাশিয়াসহ অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাই এ ব্যাপারে চীন ও রাশিয়া চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চীন উক্ত সম্মেলনকে গণতন্ত্র বিধ্বংসী জোট বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত, সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতায় প্রচন্ড মার খেয়ে বিশ্ব মোড়লগিরি ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক জোট গঠন করার চেষ্টা করছে। বিশ্বের এই বিভক্তির ভবিষ্যৎ সুখকর নয়।

যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের শেরা শক্তিধর। এটা আর্থিক, সামরিক, উদ্ভাবন তথা সব দিক দিয়েই। অবশ্য কতিপয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অভিমত, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শক্তিধর চীন। তার পর যুক্তরাষ্ট্র। শক্তির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম হোক আর দ্বিতীয়ই হোক, তা বিবেচনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে এখনো প্রভাব বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকি সেটা জাতিসংঘে পর্যন্ত। সংস্থাটি চলে সদস্যদের চাঁদায়, যার প্রায় অর্ধেক দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপেরও প্রায় সব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য সর্বাধিক। বাংলাদেশের রফতানি মূলত গার্মেন্ট, যার অধিকাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সর্বাধিক সদস্য রয়েছে বাংলাদেশের। এ খাতেও দেশের প্রচুর অর্থ আয় হয়। বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে সর্বাধিক হচ্ছে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর। ঋণের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার কারণে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের খুবই ঘনিষ্টতা রয়েছে চীন ও ভারতের সাথে। ঋণ প্রদান ও উন্নয়ন কর্মে সহায়তার ক্ষেত্রে চীন সর্বাধিক। এ নিয়ে ভারত প্রায়ই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বারবার বলেছে, চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক আর্থিক আর ভারতের সাথে সম্পর্ক হৃদয়ের, রক্তের বন্ধন। কিন্তু এ দেশের দুর্দিনে কি পাশে থাকবে ভারত? অনেকের মত, থাকবে বলে মনে হয় না। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী আচরণের ব্যাপারে ভারত পাশে দাঁড়ায়নি। কারণ, ভারতের মানসিকতা হচ্ছে শুধু নেবে, দেবে না কিছুই। যা’হোক, যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্ট নবতর সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় জাতীয় ঐক্য। তাই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় জোর তৎপরতা চালাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন