বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

‘আলট্রা-আধুনিক মানবসভ্যতা’ ধ্বংসের খাদের কিনারে

সহিংস রূপে আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৯ এএম

‘মানুষের বন্ধু আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবেশ-প্রকৃতি’। তবে সেকথা এখন অতীত। চরমভাবাপন্ন, রুক্ষ-রুগ্ন, বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে পৃথিবী আজ টালমাটাল। বাংলাদেশেও তার ধাক্কা এসে পড়েছে। বিদায়ী ২০২১ খ্রীস্টাব্দে বিশ^জুড়ে বিরূপ আবহাওয়া-জলবায়ুর মারাত্মক আগ্রাসনের নতুন মাত্রা দেখতে পেয়েছে পৃথিবীবাসী। গোটা পৃথিবী নামক গ্রহবাসীকে ভাবিত করে তুলেছে। বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতি উচ্চাভিলাষী কর্মকাÐে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী। যার পেছনে রয়েছে শিল্প-কারখানা, পরিবহন, অত্যধিক যান্ত্রিকতায় নির্ভরতাসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় খনিজ জ¦ালানি পোড়ানো ও তাতে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ, বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড বৃদ্ধি, চিরসবুজ বনাঞ্চল ধ্বংস, সমরাস্ত্র-গোলাবারুদ তৈরির উম্মত্ত প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক প্রকল্পের যথেচ্ছ প্রসার ও ক্ষতিকর বিকিরণ ইত্যাদি মনুষ্য সৃষ্ট কারণ।

এসব ক্ষেত্রে আত্মঘাতী শিল্প-উন্নয়ন কর্মকাÐ যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে স্কটল্যান্ডের গøাসগোতে অনুষ্ঠিত (৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর’২০২১ইং) বহুল আলোচিত ‘কপ-২৬’ সম্মেলন তথা জলবায়ু সম্মেলন কার্যত নিষ্ফলভাবে শেষ হয়েছে। কপ-২৬ সম্মেলনকে ঘিরে জাতিসংঘের মূল টার্গেট ছিলÑ উন্নত-ধনী দেশসমূহের জ¦ালানি তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়ানোর লাগাম টেনে ধরা, স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিল ও অন্যান্য বৈষয়িক সহায়তা জোরদার করা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দেশে দেশে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসার ইত্যাদি। কিন্তু কথিত ‘টার্গেট’ বলতে গেলে অধরাই রয়ে গেছে। যার দায় বর্তায় মূলত ধনিক দেশগুলোর এক ধরনের ‘সিন্ডিকেটেড’ একগুঁয়েমি ও ইগোর লড়াইয়ের উপর।

জলবায়ু মানে কোন এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০ থেকে ৩৫ বছরের গড় আবহাওয়া। বর্তমান বিশ্বে দ্রæত জলবায়ু পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা, অব্যাহত প্রক্রিয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাÐ ছাড়াও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পৃথিবীর গতি পরিবর্তন, সামুদ্রিক ¯্রােতসহ কিছু প্রাকৃতিক কারণও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে বৈশি^ক উষ্ণতা। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে ‘গ্রিন হাউস প্রভাব’ বলা হয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন বহুরূপে দৃশ্যমান। স্বল্পসংখ্যক বিত্তশালী দেশ ও মানুষের আত্মঘাতী কর্মকাÐের পরিণাম ফল ভোগ করছে বিশে^র বেশিরভাগ নিরীহ মানুষ। এতে করে ‘আলট্রা-আধুনিক মানবসভ্যতা’ ধ্বংসের কিনারে ঠেকেছে।

২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া-জলবায়ু, প্রকৃতি ছিল টালমাটাল। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানল ‘হিট ডোমে’ পুড়েছে। আবার মারাত্মক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তুষারঝড় আঘাত হেনেছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা, ভূমিধস, কাদার ঢল (মাড-ফ্লো), সউদী আরবে আকস্মিক অতিবৃষ্টি, বন্যা এবং মরু দেশটির অন্য প্রান্তে তুষারপাত হয়েছে। শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, পূর্বাভাসের চেয়েও দ্রæতগতিতে বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরফলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং আরো মারাত্মক ধরনের দাবানল ‘হিট ডোম’ ও তাপদাহ সৃষ্টি হবে। বিশ^ব্যাপী তাপমাত্রার পারদ তেঁতে উঠেছে। এরফলে বহুমুখী দুর্যোগ-দুর্ভোগ নেমে আসছে দেশে দেশে। মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্রমেই কঠিন, ব্যয়বহুল, অস্বাস্থ্যকর এবং দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ভয়ঙ্কর আগামীর অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে ‘চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দিতে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন’Ñ একথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান জলবায়ু বিজ্ঞানীগণ এখন স্বীকার করছেন। বর্তমান অবস্থাকে ‘আবহাওয়া-জলবায়ুর অবনতিশীল সহিংস রূপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন শীর্ষ বিজ্ঞানীরা।

বাংলাদেশেও আবহাওয়া-জলবায়ুর রুদ্ররূপ দৃশ্যমান বাস্তবতা। এরফলে অতিবৃষ্টি, খরা-অনাবৃষ্টি, ঢল-বন্যা, বজ্রপাত-বজ্রঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস, পাহাড়ধস, জনস্বাস্থ্যহানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির প্রতিনিয়ত ক্ষয়ক্ষতি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাওয়া, ফল-ফসলের আবাদ ও উৎপাদনে বিপর্যয়, একসময়ের অখÐ দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বিপজ্জনক ভাঙন, খাদ ও চোরাবালি সৃষ্টি, জোয়ারের তীব্রতায় বিস্তীর্ণ জনবসতি ও ফসল তলিয়ে যাওয়া, চট্টগ্রাম মহানগরীর ‘নাভি’ আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকায় নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারে ডুব-ভাসি, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপ, দক্ষিণের ভোলা ও দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা জেলাসহ উপকূলীয় অনেক এলাকা সমুদ্রগ্রাসে হুমকির মুখে থাকা, সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের আগা-মরা রোগ (টপ ডাইয়িং), দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বকোণে কক্সবাজারসহ অনেক জেলায় আবাদী জমিতে লবণাক্ততার মারাত্মক আগ্রাসন ইত্যাদি। এ অবস্থায় নদীভাঙন ও বাস্তুহারাদের মিছিল ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের (যার সংখ্যা একশ’র বেশি) উজানের অববাহিকায় মূল উৎসস্থলে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশে^ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ মোকাবেলায় প্রস্তুতি-ব্যবস্থাপনা দুর্বল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

আবহাওয়া-জলবায়ুর মূল ফ্যাক্টর হচ্ছে বৃষ্টিপাত। পানির ধারক বৃষ্টি। বৃষ্টির ধারক মৌসুমী বায়ু। প্রকৃতির স্বাভাবিক ছকে মেঘ-বৃষ্টির শীতল ধারায় উষ্ণ-রুক্ষ-শুষ্ক ভূপৃষ্ঠ হয়ে উঠে সিক্ত, ¯িœগ্ধ, সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটলে মানুষসহ জীব ও উদ্ভিদজগৎ বিপন্ন হয়ে পড়ে। মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, “তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু (মৌসুমী বায়ুমালা) প্রেরণ করেন; অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চারিত ও চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালা) স্তরে স্তরে রাখেন, খÐ-বিখÐ করে দেন। এরফলে তুমি দেখতে পাও তার (মেঘ) মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টির ধারা। তিনি তাঁর বান্দাহদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা তা পৌঁছান; তখন তারা হয় আনন্দিত”। (সুরা আর-রুম ৩০ : ৪৮)। “আমি পানিবাহী মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি; যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও পাতাঘন উদ্যানসমূহ”। (সুরা-নাবা ৭৮ : আয়াত ১৪-১৬)।
পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু জীবনধারণে পানির প্রধান উৎস বৃষ্টিপাতের ছক বা নিয়ম ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া-জলবায়ু প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠার সাথেই বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতে অস্বাভাবিক অসঙ্গতি হচ্ছে। বিভাগ-জেলা বা অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতে অনিয়ম ব্যাপক। পঞ্জিকার পাতায় আষাঢ়-শ্রাবণ ‘বর্ষা ঋতু’। অথচ বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদী, শাখানদী, উপনদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়ে পানির সমতল স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে রয়েছে। এতে করে ফল-ফসল, ক্ষেত-খামারে চাষাবাদে ভরা বর্ষাতেই পানির অভাবে টানাটানি পড়ে গেছে। ফসলের মাঠে বর্ষাকালীন মাটির ‘স্বাভাবিক’ আর্দ্রতা বা সিক্ততা কম। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ (পুনর্ভরণ) হচ্ছেনা। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে কৃষি-খামার ছাড়াও পরিবেশ-প্রকৃতিতে বিপদ ডেকে আনছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র মতে, রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট। ২০০০ সালে তা নেমে যায় ৬২ ফুটে। ২০০৭ সালে আরও নেমে গেছে ৯৩ দশমিক ৩৪ ফুটে।

রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর তথা উত্তরের জনপদে আবহাওয়া-জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার কোটি কোটি মানুষ। এর প্রভাব পড়েছে পরিবেশ-প্রকৃতি, কৃষি-খামার ছাড়াও মানুষের জীবনধারণ, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। কৃষি-প্রধান উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাব সারাবছরই। নদ-নদী, খাল-বিলসহ পানির উৎসগুলো প্রায় তলানিতে অথবা পানি ধারণক্ষমতার নিচে। ফল-ফসল রক্ষায় গভীর নলকূপ এবং প্রচলিত দেশীয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিকল্প উপায়ে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষককে। জমি ভিজিয়ে রাখতে হচ্ছে কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে। এতে করে কৃষি-ক্ষেত খামারে আবাদ ও উৎপাদন খরচ বাড়ছে। দিশেহারা কৃষক। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত অপ্রতুল। উত্তরাঞ্চলে অনাবৃষ্টিতে উঠতি, আধা-পাকা ফসল, খাদ্যশস্য, পাট, শাক-সবজি, ফলমূল বিবর্ণ হয়ে ফলন মার খাচ্ছে।

বাংলাদেশেও ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতি মাস, বছরের গড় তাপমাত্রার হিসাবে। বৃষ্টিপাতেও ব্যাপক অসঙ্গতি হচ্ছে। অন্যদিকে মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চল। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মো. রিয়াজ আখতার মল্লিক এক গবেষণায় জানান, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বৃষ্টিপাতের পারিমাণ বেড়ে গেছে। যা বার্ষিক গড়ে অন্তত ২৫০ মিলিমিটার। সীমিত জায়গা বা এলাকায় হঠাৎ ও স্বল্প সময়কালীন অতি বর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে জনদুর্ভোগ। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহর-নগরে পানিবদ্ধতার এটি প্রধান দিক। গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। যা ডিসেম্বর মাসে এক দিনে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ৫০ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

আবহমানকালের আবহাওয়া-জলবায়ুর চিরচেনা রূপ ও বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। চিরায়ত ষড়ঋতুর আদি চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্জিকার ছকে ‘বর্ষা’য় বৃষ্টি ঝরে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অকালে’ অঝোর বর্ষণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘন ঘন প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ও অতিবর্ষণে ভাসছে। ছোট ছোট জলোচ্ছ¡াসের প্রকোপ বাড়ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য থাকায় গ্রীষ্মের খরতাপ যেন মরুর আগুনের হলকা। অসহনীয় ‘গরমকাল’ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু ‘শীতকাল’র স্থায়ীত্ব অল্প কিছুদিন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পঞ্জিকার পাতায় থাকলেও আলাদা করে চেনা যায় না, জনজীবনে তেমন অনুভূতি জাগায় না। আবহাওয়া-জলবায়ু এখন জটিল সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ধকলে হ্রাস পাচ্ছে মানবসম্পদের উৎপাদনশীলতা।

কৃষি-খামার, জীবন-জীবিকা, জনস্বাস্থ্য, উন্নয়ন কর্মকাÐসহ জনজীবনের অনেক ক্ষেত্রে পড়ছে কমবেশি বিরূপ প্রভাব। প্রাদুর্ভাব ঘটছে অতিআর্দ্র ও উষ্ণতা, মৌসুমী ভাইরাসজনিত (ট্রপিক্যাল) মানুষের হরেক রোগ-ব্যাধির। দেহে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমছে। গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকুল হারিয়ে ফেলছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। বাড়ছে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের সংক্রমণ। কৃষিজ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, পুষ্টিমান কমছে। সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. হোসেন জামাল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রজগতে পড়ছে বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাব। বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সাগর-মহাসাগরের পানিতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের হার কমছে। সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুলের বিচরণ বিঘিœত হচ্ছে। উদ্ভিদগুল্ম হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। সাগরে মাছসহ প্রাণিজগতের খাদ্য-শৃঙ্খল বিঘিœত হয়ে পড়ছে। প্রজনন ও উৎপাদনশীলতা হচ্ছে ব্যাহত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে দেশে দুর্যোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। নানামুখী দুর্যোগে ২০২০ সালে ৪ কোটি মানুষ স্থানান্তর এবং এরমধ্যে ৩ কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানায় ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি)। এতে বলা হয়, গৃহহারা মানুষের ৮০ শতাংশই এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বাসিন্দা। যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

জার্মানির ভয়াবহ বন্যা, উত্তর আমেরিকার হিট ডোম, যা স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানলসহ বিশে^র দেশে দেশে ঘটমান নজিরবিহীন ও চরম দুর্যোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। তবে তারা কয়েক দশক যাবৎ সতর্ক করে আসছেন দ্রæতগতিতে বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং আরও মারাত্মক ধরনের দাবানল ও তাবদাহের সৃষ্টি হবে। এরজন্য গবেষণায় সুপার কম্পিউটার প্রয়োজন বলে তারা তাগিদ দিয়েছেন। জলবায়ু বিজ্ঞানী ও যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া বিভাগের সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ডেম জুলিয়া ¯িøংগো বলেন, আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস প্রদানের ক্ষেত্রে আইপিসিসির মডেলগুলো যথেষ্ট নয়। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। আন্তর্জাতিক একটি কেন্দ্র্র দরকার যাতে জলবায়ুর মডেলগুলোর উন্নতি সম্ভব হয়। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী অধ্যাপক টিম পালমার বলেন, আমরা কতটা জরুরি অবস্থায় আছি বলা কঠিন। কারণ পর্যাপ্ত সরঞ্জাম আমাদের হাতে নেই। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির দাবানল, বন্যার নিখুঁত পূর্বাভাস বর্তমান অবস্থায় সম্ভব নয়।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৫০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যার জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে কৃষি। কিন্তু আগামী দিনে কৃষির সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি এবং সর্বাপেক্ষা বড় প্রভাব পড়ে কৃষিখাতে। বাংলাদেশের কৃষি-খামার সেক্টরও জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল মোকাবিলা করেই এগুচ্ছে। কর্মবীর কৃষকগণ তাদের সর্বোচ্চ শ্রম ও বৃদ্ধি প্রয়োগ করেই ফলাচ্ছেন সোনার ফসল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নেমে আসা একের পর এক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কারণে সোনার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। স্বপ্ন ভাঙছে কৃষকের। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে চলতি শতাব্দীর শেষে স্থানভেদে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ ফসলের উৎপাদন কমে যেতে পারে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত করে তুলবে। কৃষি বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো অবিলম্বে শনাক্ত করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু-বান্ধব বা সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশল, অভিযোজন প্রক্রিয়া, কলাকৌশল এবং প্রযুক্তি, বুদ্ধি-কৌশলসমূহকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে।
*লেখক: শফিউল আলম, উপ-সম্পাদক ও ব্যুরো প্রধান,
দৈনিক ইনকিলাব চট্টগ্রাম ব্যুরো

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন