বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

জয়ের ব্যাটে জয়ধ্বনি

স্পোর্টস রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

গত নভেম্বরে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক। মিরপুরের সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে শূন্য, দ্বিতীয়টিতে ৬। মাস দেড়েক আগের ঐ পারফরম্যান্সের পর কেউ যদি বলত, বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ওপেন করবেন মাহমুদুল হাসান জয়, দলের ইনিংস শুরু করবেন নিউজিল্যান্ড, তিনি নিজেও হয়তো হেসে উড়িয়ে দিতেন। সেই মাহমুদুল ওপেনার হিসেবেই গড়লেন এমন নজির, যা করতে পারেননি বাংলাদেশের আর কেউ! টেস্ট দলের হয়ে প্রথম সফরে তরুণ ব্যাটসম্যান নাম লেখালেন রেকর্ডের পাতায়। ১৬৫ বলে ফিফটি। দিন শেষে ২১১ বলে অপরাজিত ৭০। গতকাল মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের দ্বিতীয় দিনটায় নিজেকে যেন নতুন করে চেনালেন মাহমুদুল। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ওপেনার নিউজিল্যান্ডে খেলতে পারল দেড়শর বেশি বল। এই তথ্য আর সংখ্যাগুলিতে ফুটে উঠছে ধৈর্য। যেভাবে সংখ্যাগুলির জন্ম, তাতে মিশে আছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও হাল না ছাড়া মানসিকতা। ধৈর্য আর প্রতিজ্ঞার মিশেলে ধ্রæপদি টেস্ট ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছিবি যেন। মাহমুদুলকে ওপেনার বানানো ছিল বড় একটা চমক। তিনি আরও বেশি চমকে দিলেন ব্যাটিং দিয়ে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক জানান, মাহমুদুলকে ওপেনার হিসেবে দেখছে দল। দেশের ক্রিকেটে তখন প্রশ্ন আর বিস্ময়ের ঝড়। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচে ওপেন করে সাফল্য তার আছে বটে। তবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই তিনি তিন-চারে ব্যাট করেন মূলত। যুব টেস্টে খেলেছেন ওই পজিশনগুলোতেই, সেখানে সেঞ্চুরিও আছে চারে নেমে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একবারই ওপেন করার অভিজ্ঞতা তার ছিল আগে। এমন একজনকে ওপেনার বানানো যেমন আলোচনার খোরাক হওয়ার মতো, তেমনি তা ফুটিয়ে তোলে দেশের পাইপলাইনের দীনতাও। বিকল্প উপযুক্ত ওপেনার না পেয়ে তরুণ প্রতিভাবান একজনের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ টানাটানি!

তবে পজিশন যেটাই হোক, তার জন্য এটি বড় সুযোগ। তিনি এমনভাবে সুযোগটা নিলেন, নিজেকেই চেনালেন নতুন করে। নিউজিল্যান্ডে চ্যালেঞ্জটা আরও কঠিন। বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানরাও ওখানকার কন্ডিশনে মানিয়ে নিতে হিমশিম খান। বাংলাদেশের আছে সেখানে অনেক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। কন্ডিশনকে কাজে লাগানোর মতো দুর্দান্ত পেস আক্রমণ কিউইদের। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নিল ওয়্যাগনার ও কাইল জেমিসনকে নিয়ে গড়া পেস আক্রমণ দলকে এনে দিয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি। বিরুদ্ধ এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও মাহমুদুল মেলে ধরলেন নিজেকে।

বে ওভালের উইকেট অবশ্য এবার ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ ভালো। টেস্টের আগে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচে ফিফটি করে কিছুটা আত্মবিশ্বাসও সঙ্গী হওয়ার কথা মাহমুদুলের। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞতায় তিনি উইকেট আঁকড়ে রাখলেন দুই সেশনের বেশি। ইনিংসটি নিখুঁত ছিল না অবশ্যই। বরং নাভার্স মুহূর্ত এসেছে অনেক। অস্বস্তিও ফুটে উঠেছে বেশ কবার। নিউজিল্যান্ড রিভিউ নিলে তিনি আউট হতে পারতেন ২০ রানেই। এছাড়া তার টেকনিক ও স্কিলের কিছু ঘাটতিও প্রকাশ্য হয়েছে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ডিফেন্স করেছেন বারবার, যেগুলো ছেড়ে দেওয়া যায় অনায়াসেই। সেই চেষ্টায় বিপদেও প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন কয়েক দফায়। শাফল করে মিডল স্টাম্প থেকে ফ্লিক করার প্রবণতাও দেখা গেছে বারবার, ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ যা।

তবে দিনটি ছিল তার। লড়াই চালিয়ে দিনটি নিজের করে নেওয়ার কৃতিত্বও তার। মাত্র ৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতায় টেস্ট খেলতে নামা ২১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দুর্বলতা কিছু থাকাই স্বাভাবিক। সেসব নিয়ে কাজ করার সময়ও আছে সামনে। কিন্তু ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই যে টেম্পারমেন্ট, যে মানসিকতার ছাপ তিনি রেখেছেন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি সেখানেই।

বল অনেকটা দেরিতে খেলার চেষ্টা করেছেন, যা বড় ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। বাড়তি বাউন্স সামলেছেন সফট হ্যান্ডে খেলে দারুণ দক্ষতায়। কিউই পেস আক্রমণ তো স্কিলের পরীক্ষা কম নেয়নি। নিজের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাতে উতরে গেছেন মাহমুদুল। রানিং বিটুউইন দা উইকেট ছিল দুর্দান্ত। সবকিছু ছাপিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে উইকেটে পড়ে থাকার যে তাড়না, সেটিই তার ইনিংসকে করে তুলেছে বিশেষ কিছু।
মাহমুদুলের এমন ইনিংস, ফিফটি করা নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে প্রায় ৪০ ওভারে ১০৪ রানের জুটি আর সকালের সেশনে দারুণ বোলিং মিলিয়ে দিনটি বাংলাদেশের কেটেছে দুর্দান্ত। বল হাতে তিন উইকেট নেওয়া অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, মাহমুদুলকে তারা লম্বা দৌড়ের ঘোড়া বলেই মনে করেন, ‘আমাদের দলের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক দিক এটা (মাহমুদুলের ব্যাটিং)। অনেক ভালো ব্যাট করেছে সে, সময় নিয়েছে। ও যে নতুন খেলোয়াড়, এরকম কিছু মনে হচ্ছিল না ওর ব্যাটিং দেখে। নিজেকে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে। আমরা জানি যে সে খুব ভালো ক্রিকেটার। অন‚র্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের একজন। ওখানে অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করেছে। ভালো খেলেই জাতীয় দলে এসেছে। কেবলই শুরু, বাংলাদেশকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে ওর, আমি মনে করি। দলের সবাই তার প্রশংসা করেছে। যেভাবে খেলেছে, দলের জন্য যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি তার ক্যারিয়ারের জন্যও।’

শুধু সতীর্থ কেন, ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের ব্যাটারদের উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করেন নিউজিল্যান্ডের পেসার ওয়াগনারও। বিশেষ করে জয়ের ব্যাটিং মনে ধরেছে তার। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তরুণ ছেলেটা আজ (কাল) অসাধারণ খেলেছে। তারা ধৈর্য ধরে খেলেছে। আমাদের খুব বেশি সুযোগ দেয়নি। সেখানে (উইকেটে) ঝুলে ছিল। অনেক বল ছেড়েছে। এটা আমাদের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে এবং উইকেট নেওয়া কঠিন করে তুলেছে। এটা তাদের রান করার সুযোগ দিয়েছে। পুরো কৃতিত্ব তাদের। আমার মনে হয় যখন রান করার দরকার, তখন তারা করেছে। তারাও ভালো (বল) ছেড়েছে এবং ভালো রক্ষণও করেছে।’

অথচ যে কোনো সংস্করণের ক্রিকেটে আগ্রাসী ব্যাটিং যেন টাইগারদের স্বাভাবিক খেলা। তাতে শুরুতেই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়াও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এদিনও এমন ব্যাটিং প্রত্যাশা ছিল তাদের। কিন্তু টাইগারদের ব্যাটিং কিছুটা হলেও অবাক করেছে তাদের। ওয়াগনারের ভাষায়, ‘বাংলাদেশ যখনই এখানে এসেছে সবসময় বেশ শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল। তারা সবসময় আমাদের কন্ডিশনে ভালো খেলেছে। সাকিবের মতোই ভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলে। তারা বেশ আক্রমণাত্মকভাবে খেলে, অনেক শট খেলে। এটা আমাদের উইকেট নেওয়ারও সুযোগ তৈরি করে দেয়। তারা মানসম্পন্ন খেলোয়াড় এবং বেশ কিছুদিন ধরেই রয়েছে।’

সবচেয়ে গুরুত্বপ‚র্ণ, সাড়ে ৪ ঘণ্টা ব্যাট করে দিন শেষ করেছেন তিনি অপরাজিত থেকেই। নতুন দিনের জন্য দলও তাই পাচ্ছে নতুন আশার রসদ। তার সামনেও হাতছানি পরম কাক্সিক্ষত টেস্ট সেঞ্চুরির!

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন