বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভারতে দু’টি টর্চার সেল

ইউরোপের কথা বলে সীমান্ত পার : কলকাতা-দিল্লিতে জিম্মি নেপথ্যে পাঁচ চক্র : কলকাতায় সেফ হোমেই আধার কার্ড তৈরি ষ দুবাইয়ের জন্য টার্গেট সুন্দরী তরুণীরা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, রোমানিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স এবং মাল্টায় উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে বাংলাদেশিদের পাচার করা হচ্ছে ভারতে। পাচারের পর দিল্লি ও কলকাতায় টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন করে আদায় করা হয় অর্থ। ভারত ও বাংলাদেশি মিলে পাঁচটি বড় চক্র গত পাঁচ বছরে এক হাজারের অধিক বাংলাদেশিকে পাচার করেছে।

একই সাথে সুন্দরী তরুণী ও মহিলাদের চাকরির নামে দুবাই-ভারতে পাচারের পর দুবাই ড্যান্স ক্লাবে বিক্রি এবং দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে ওই পাঁচ চক্রের বিরুদ্ধে। মানবপাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ৫ চক্রের ৩ শতাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকলেও ভারত-বাংলাদেশের ১৪ জন পুরো নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে।

পাচার চক্রের কাছে অনেকেই ‘বড় বাবু’ হিসেবেও পরিচিত। এদের মধ্যে কলকাতার রাজিব খান, মানিক ও দিল্লির রবিন সিং অন্যতম। বাংলাদেশে এ সিন্ডিকেটের মূল হোতারা হচ্ছে- ডালিম, রনি, শাহীন, মল্লিক রেজাউল হক ওরফে সেলিম, মো. কামালউদ্দিন ওরফে হাজী কামাল, খালিদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তার ও মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন।

র‌্যাব ও সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও যশোরসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে পাচার হওয়া নারীদের ভারতের ছয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়–, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্নাটক ও উত্তরপ্রদেশে পাঠানো হয়। এসব রাজ্যের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, ম্যাসাজ পারলার ও স্পা সেন্টারে রেখে তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত তালিকায় ৪০ জনের নাম রয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের পর দিল্লি ও কলকাতায় টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন এবং অর্থ আদায় করাসহ সব বিষয় আমরা পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। আমরা মানবপাচারের বিষয়গুলো মনিটরিং করছি। র‌্যাবের কাছে ভারতে মানবপাচারের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। আর সেসব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চাকরি দেয়ার নামে দেশি-বিদেশি চক্র প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে। মানবপাচারকারীরা অনেকের আর্থসামাজিক অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে ভালো চাকরির টোপ দিয়ে পাচার করা নারীদের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে।

পাচারের শিকার প্রায় ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৫ শতাংশ শিশু। পাচারের সঙ্গে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীদের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সির নামও এসেছে। তারা বেশি টাকার বিনিময়ে অবৈধ উপায়ে বিদেশে কাজের নামে পাচার করে।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা বলে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তিকে ভারতে পচার করে দেয় একটি চক্র। পাচার হওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভারতের কলকাতায় আটক রাখা হয় জাহাঙ্গীরকে। আটক অবস্থায় কলকাতার টর্চার সেলে তাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।

তিনি বলেন, নির্যাতনের এসব ভিডিও দেশে থাকা তার পরিবারকে দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায় করে পাচারকারী চক্রটি। দেশে এসে ভিকটিম জাহাঙ্গীর চক্রটির বিরুদ্ধে র‌্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে। তার দেয়া তথ্য ও অভিযোগ যাচাই করে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া ভারতেও তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কলকাতার রাজিব খান, মানিক ও দিল্লির রবিন সিংয়ের নাম পাওয়া যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচারের করে আসছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারে দেশে পাঁচটি বড় চক্র সক্রিয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর মনোভাব ও ধারাবাহিক অভিযানে গত বছর গ্রেফতার হয়েছে অর্ধশতাধিক চক্র। আকাশপথে মানবপাচারে দুইটি এয়ারলাইন্সের সম্পৃক্ততা পেয়েছে সিআইডি। কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশও রয়েছে। ধাপে ধাপে মানবপাচার হওয়ায় দালালসহ দুই-তিন ধাপের পাচারকারীর ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলহোতারা আইনের আওতায় আসে না।

পাচারকারী মূলহোতাদের একটি বড় অংশ পরিবার নিয়ে বিদেশেই অবস্থান করে। অকাট্য তথ্য-প্রমাণাদির অভাবে রাঘববোয়ালদের চার্জশিটভুক্ত আসামি করা যায় না বলে জানিয়েছেন মানবপাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্তকারী একাধিক কর্মকর্তা। মানবপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোতাদের একটি বড় অংশই মধ্যপাচ্যে অবস্থান করছে। ইউরোপেও রয়েছে কয়েকজন।

পাচারের পর দেশে ফিরে আসা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মূলত উন্নত জীবনের হাতছানিতে তারা ঝুঁকি নিয়ে দেশের বাইরে যান। পেটের দায়ে কাজ করে খেতে তারা বিদেশে গিয়েছিলেন। বিদেশে গেলে নিজে ভালোভাবে খেতে পারবে। পরিবারকেও ভরণপোষণ করাতে পারবে বলে তাদের প্রলোভন দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু অবৈধ পন্থায় বিদেশে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এখন চাইলে দেশেও ফিরতে পারছেন না। আবার দেশে ধারদেনা করে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে যান, সেই ধারদেনাও পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনও হয়রানির শিকার হচ্ছে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের অপরাধীরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র গড়ে তুলেছে। এই চক্রের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতে গ্রেফতার ১১ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পাচারের পর ভারত থেকে পালিয়ে আসা একাধিক তরুণী বলেন, ভারতের সেফ হোমে জিম্মি রেখে তাদের ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চালিয়ে তা ভিডিও ধারণ করা হতো।

এক সময় তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে পুলিশের ভয় দেখিয়ে এবং তাদের স্বজনদের কাছে পাঠানোর কথা বলে যৌনকাজে বাধ্য করা হতো। এভাবে ভারতে নারী পাচারে বাংলাদেশের ভেতরে সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি চক্র। আর সীমান্তের ওপারে কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে রয়েছে তিনটি চক্র। সেখানে ভারতীয়রা নেতৃত্ব দিলেও বাংলাদেশিরাও সম্পৃক্ত রয়েছে।

পাচার হওয়া তরুণীরা ফিরে পুলিশকে জানান, সীমান্ত পার করার পর তাদের প্রথমে কলকাতায় নেয়া হয়। সেখানে এই চক্রের সেফ হোমে রেখে ভারতের আধার কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) তৈরি করে দেয়া হয়। এরপর উড়োজাহাজ বা ট্রেনে করে তাদের বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়। কলকাতায় এই কাজের নেতৃত্ব দেন বকুল ওরফে খোকন। আর বেঙ্গালুরুতে যাওয়ার পর তাসলিমা ওরফে বিউটি এবং অখিলের নেতৃত্বে দুটি চক্র পুরো বন্দোবস্ত করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
বিধান কবিরাজ ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:৫৮ এএম says : 0
সরকার ও প্রশাসন ব্যস্ত আছে সরকারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে। এসব দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই।
Total Reply(0)
নাজমুল হাসান ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:৫৯ এএম says : 0
অবৈধ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে একটা অভিযান চালানোর দরকার।
Total Reply(0)
হুসাইন আহমেদ হেলাল ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০০ এএম says : 0
ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, সেখানে এই ধরনের টর্চার সেল পরিচালনার সুযোগ পায় কিভাবে।
Total Reply(0)
নিরব হেলাল ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০১ এএম says : 0
যারা ইতোমধ্যে পাচারের শিখার হয়েছে তাদের দ্রুত উদ্ধার করে আনার দাবি জানাচ্ছি।
Total Reply(0)
নিলিমা জাহান তনুশ্রী ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০২ এএম says : 0
ইউরোপের কথা শুনেই যারা এক পায়ে খাড়া হয়ে যান, তারাই এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। মানুষের সচেতন হওয়া উচিত।
Total Reply(0)
মিফতাহুল জান্নাত ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০২ এএম says : 0
প্রশাসন কি করে! এগুলো চোখে পড়ে না।
Total Reply(0)
কায়কোবাদ মিলন ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০৫ এএম says : 0
অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হোক এবং একটি অভিযোগ সেল গঠন করা হোক।
Total Reply(0)
عمر فاروق ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ৬:৫৪ এএম says : 0
এমন আরো অনেক অপরাধ দেশে থাকতে পারে,আল্লাহ প্রশাসনকে সেগুলো বের করার তৌফিক দান করুন ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন