শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জরিপে বাপেক্সের লুটপাট

আট বছরেও শুরু হয়নি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বহুমাত্রিক জরিপ

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়া হলেও বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের কারণে এখনো জরিপ শুরু হয়নি। জরিপের জন্য জাহাজ ঠিক করা হয়নি। সাগরে বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনার মাধ্যমেই সেই তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে। আট বছর আগে এ প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। অথচ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বহুমাত্রিক জরিপের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন লিমিটেডের (বাপেক্স) এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমি এ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি নতুন। সব কিছু জানার পরে বলতে পারব। তার আগে কিছুই বলতে পারছি না।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে। দীর্ঘ আট বছর পরে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে পেট্রোবাংলা। জ্বালানি বিভাগে পাঠানো এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ফেইজের কাজ শুরু করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রথম ফেইজে ১৩ হাজার ৬০০ কিলেমিটার দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপ করা হবে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের কাছ থেকে এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ পায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ কিলোমিটারের বিশাল সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। যা বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের কাছাকাছি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো যখন সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করছে তখন আমরা কেবল ঢেউ গুনে দিন পার করছি।

বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে শরীয়তপুরে তেল-গ্যাস কূপ খননের জন্য জমি অধিগ্রহণের পর দুই বছরের অনুসন্ধানের জন্য রাস্তাঘাট-কালভার্ট করা হচ্ছে।
এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন উপ-মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক (শরীয়তপুর-১) খনন প্রকল্প মো. তোফায়েল উদ্দিন শিকদার। সিকদার বলেন, এখানে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যেই কূপ খনন করা হচ্ছে। আমরা কূপ খনন করে টেস্টিং করব। রেজাল্টের ভিত্তিতে গ্যাসের অবস্থা বুঝতে পারব। এরপর গ্যাসের পরিমাণের ওপরে মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে কার্যক্রম নেয়া হবে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালেই সমুদ্রে জরিপ চালিয়ে তথ্য নিয়েছে মিয়ানমার। আর দেশে অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত করে গ্যাস আমদানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। তারাই নানা অজুহাতে সমুদ্রে জরিপের কাজটি পিছিয়ে দিচ্ছে। পছন্দের কোম্পানি জরিপের কাজ না পাওয়ায় তদবির করে আবার দরপত্র করিয়েছে আরেকটি চক্র। মাঝে তারা সরকারিভাবে জরিপের প্রস্তাবও দিয়েছিল। জাহাজ কিনে নিজেরা জরিপ করতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করেছিল জ্বালানি বিভাগ। পরে এটি বাতিল করা হয়েছে।

২০১৪ সালে সাগরে বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় পেট্রোবাংলা। পরের বছর ২০১৫ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ১৫ দিনের মধ্যে দরপত্র মূল্যায়ন করে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। এর কিছুদিন পর আবার দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয় জ্বালানি বিভাগ। ২০১৬ সালে পুনঃদরপত্রে একই কোম্পানি নির্বাচিত হয়। গত বছরের মার্চে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে জরিপের কাজটি করবে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রান্সের কোম্পানি সøাম বে জ্যে এর যৌথ কনসোর্টিয়াম। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির কাছে জরিপের তথ্য বিক্রি করে তাদের বিনিয়োগের টাকা তুলে আনবে। চুক্তি অনুসারে এক বছরের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার কথা ছিল। আর এর পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জরিপ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত মার্চে বিস্ততারিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে কনসোর্টিয়াম। সমুদ্রের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় দ্বিমাত্রিক জরিপ চালানোর কথা তাদের। কাজ শুরু করতে গত বছর পরিবেশগত ছাড়পত্রও নিয়েছে কোম্পানিটি।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালের দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে প্রথম হয় টিজিএস-সøাম বে জ্যে। এটি বাতিল করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। পরের বছর আবার প্রথম হয় টিজিএস-সøাম বে জ্যে। এরপর দরপত্র মূল্যায়ন করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ৯ মাস পর প্রতিবেদন দেয় তারা। ২০১৯-এর এপ্রিলে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়ার প্রায় এক বছর পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০২১ সালে। পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা খারাপের দিকে। সমুদ্রে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করার দরপত্র ঝুলে আছে। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সব মিলে ব্লক (অনুসন্ধান এলাকা) আছে ২৬টি। এর মধ্যে অগভীর সমুদ্রে ১১টি আর গভীর সমুদ্রে ১৫টি। গভীর সমুদ্রে এখন কোনো কাজ চলছে না। সব মিলে ২৪টি ব্লক এখন খালি পড়ে আছে। ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এর আগে পরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও নানা কারণে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়।

বঙ্গোপসাগরে ২৬টি ব্লকের দুটিতে এখন অনুসন্ধানকাজ করছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড। জরিপ শেষ হলেও নির্ধারিত সময়ে কূপ খনন করতে পারেনি তারা। নতুন করে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়েছে। মজুত কমে আসায় এক বছর ধরে গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। সামনে এলএনজি আমদানি আরো বাড়তে পারে। বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ সালে শরীয়তপুরের মেঘনা নদীর তীর থেকে খুলনা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে দ্বিমাত্রিক সিসমিক জরিপ হয়। জরিপে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা ইউনিয়নের দিনারা গ্রামে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। চলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরে জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে তৈরি করা হয় ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় বছর মেয়াদে শরীয়তপুর তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্প-১ গত ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ চলবে।

এজন্য ৬ দশমিক ৪৯ একর জমি দুই বছরের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। ফসলি জমির চারদিক পাইলিং করে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে প্রকল্প এলাকায়। ওই এলাকায় ভারী যন্ত্রপাতি আনা- নেয়ার কাজের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক ও কালভার্ট। দিনারা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ জমির মালিককে ক্ষতিপূরণের জন্য দেয়া হয়েছে সর্বশেষ নোটিশ। দুই বছরের ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৬ টাকা। গ্যাস উত্তোলন করা না গেলে কী হবে এই জমির, তা নিয়ে তাদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ স্থানীয়রাই দেখছেন নতুন সম্ভাবনা। গ্যাস না পেলেও এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে।

বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। প্রথম ফেইজে ১৩ হাজার ৬০০ কিলেমিটার দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপ করা হবে। সার্ভের কাজ শুরু করবে টিজিএস এবং সøামবার্জার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কোম্পানি। এর আগে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের জন্য দুদফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দুবারই অনুসন্ধান কোম্পানি সøামবার্জার সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট কারো পছন্দের কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হতে না পারাতে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন