কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাটিকে দেখলে মনে হবে এটি যেন রোজ কেয়ামতের কোন দৃশ্য। শুক্রবার শহরটি পরিদর্শেনে যান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতারা। তাদের বর্ণনা তুলে ধরা হল-
শুক্রবার ভোরবেলা এই শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল পোড়া টায়ারের গন্ধে ভারি হয়ে আছে আকাশ-বাতাস। রাস্তায় লোকজন খুবই কম। অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরুতে সাহস পাচ্ছেন না। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছিল গণবিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে এখন সেনা ও পুলিশের রোডব্লক।
আমরা যখন আলমাটি শহরের প্রধান স্কয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে সৈন্যরা চিৎকার করে আমাদের কাছে যেতে বারণ করলো এবং আকাশে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো। আমি বেশ ক'বছর ধরে নিয়মিতভাবে আলমাটি গিয়েছি। স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিশাল শহরটি থাকে কর্মচঞ্চল। প্রচুর সবুজ জায়গা রয়েছে শহরে। রয়েছে খানা-পিনার অঢেল ব্যবস্থা। কিন্তু আলমাটির বহু দোকান-পাট আর ব্যাংক এখন বন্ধ। সেগুলোতে লুঠতরাজ হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।
আলমাটিতে বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রধান স্কয়ারের আশেপাশে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এখানেই প্রতিবাদকারীরা প্রথম জড়ো হয়। এসময় আশেপাশের সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিস হামলার শিকার হয় এবং মেয়রের অফিস পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। ভবনটির রঙ এখন কালো। এখনও সেখান থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল।
কিছু লোককে দেখা গেল মোবাইল ফেনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে। এখানকার কিছু বাসিন্দা, যাদের সাথে আমি কথা বলি, তারা জানালেন তারা হতবাক আর ক্ষুব্ধ। কাজাখস্তানে এধরনের সহিংস বিক্ষোভ এক বিরল ঘটনা। যে দ্রুততার সঙ্গে এই সহিংসতা ছড়িয়েছে তাতে তারা অবাক হয়ে গেছেন।
কিছু লোক অবশ্য বললেন, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে সৈন্য আসাতে তারা খুশি হয়েছেন। তারা আশা করছেন, এতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। একজন নারী বললেন, সরকারের উচিত ছিল একেবারে গোড়া থেকেই কঠোর হাতে এসব দমন করা। "শুরু থেকে বল প্রয়োগ করলে এসব ঘটতো না," বলছেন তিনি, "সম্ভবত অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তারা নিন্দার ভয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু দেখুন এখন কী হাল।"
সহিংসতা নিয়ে রাগ থাকলেও প্রতিবাদকারীদের প্রতিও রয়েছে কিছু মানুষের সহানুভূতি। এসব বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন এমন অনেক মানুষ এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের আয় কম এবং সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। "তাদের যেসব দাবিদাওয়ার ব্যাপারটি আমরা বুঝতে পারি," বলছিলেন ২২-বছর বয়সী একজন যিনি পাচক হিসেবে কাজ করেন, "তাদের বেতন বাড়ছে না, জনগণের বেশিরভাগই বহু কষ্টে জীবনযাপন করেছন। কিন্তু এখনকার ভাংচুর আর গুণ্ডামিতেও সাধারণ মানুষই কষ্ট পাচ্ছে। এসব বন্ধ হওয়া দরকার।"
আলমাটির বাসিন্দাদের সামনে রয়েছে খাদ্য সঙ্কট। সুপারমার্কেটগুলো এখন বন্ধ। যেসব দোকান খোলা তারা শুধু নগদ অর্থে বেচাকেনা করে। এটিএম থেকে টাকা তোলা বেশ কঠিন। শহরে কোন ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এমনকি রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়াও কঠিন। ইন্টারনেট আর ফোন না থাকার কারণে দেশের অন্য জায়গায় কী ঘটছে তা জানাও কঠিন। এত গুজব বাতাস উড়ছে যে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করা কঠিন।
কাজাখস্তানে আগে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে তার সবাই মূলত ছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এর কোনটিতেই বিমানবন্দরের ওপর কোন হামলা হয়নি। সর্ব-সম্প্রতি এই বিক্ষোভ শুরু হয় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ছিল ব্যাপক অসন্তোষ। কাজাখস্তানের স্বাধীনতার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েফ দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেন। ২০১৯ সালে তার পদত্যাগের পর কাজাখরা আশা করেছিলেন যে নতুন প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ দেশে বড় ধরনরে পরিবর্তন আনবেন।
কিন্তু তারা আশাহত হন। এর মধ্যে একটি ঘটনায় রাজধানী আস্টানার নতুন নামকরণ করা হয় নুর-সুলতান। এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে আগের সরকারের লোকজনের হাতেই ক্ষমতা রয়ে গেছে। এখন কাজাখস্তানের পরিস্থিতি বেশ শান্ত এবং দেশের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যত সরকারের হাতে। কিন্তু বিক্ষোভ আপাতত থামলেও অসন্তোষ রয়েই গেছে। ফলে যে কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে আবার বিক্ষোভে আগুন ধরে যেতে পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন