শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মতামত : কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি ও পাঠ্যক্রম

প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার নামে দুটি কোর্স চালু আছে। একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা, অপরটি সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসা। কওমি মাদ্রাসার কোনো সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় এ মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ হাজার হাজার আলেম-ওলামার বাংলাদেশের শিক্ষিত নাগরিকের তালিকায় তাদের নাম নেই। স্বীকৃতির দাবিতে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মতানৈক্যের কারণে স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি সরকার কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিতে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কোর্সটির আংশিক সংশোধন করার লক্ষ্যে কিছু মতামত তুলে ধরা হলো। কওমি মাদ্রাসার সকল বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে প্রচলিত কোর্সটির আংশিক সংশোধন এখন যুগের দাবি।
বাংলাদেশে বর্তমানে কওমি মাদ্রাসায় প্রচলিত শিক্ষা কোর্সটি তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনামলের প্রেক্ষাপটে প্রণীত। ভারতের পরাধীন মুসলমানদের ধর্মীয় জাগরণ ও সত্যিকার দ্বীনি এলেম অর্জনের লক্ষ্যে ভারতের বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কোর্সটি চালু করা হয়। তৎকালীন ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ কোর্সটি তখন সময়োপযোগী ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে এ কোর্সটির সংশোধন এখন যুগের দাবি।
স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার কোর্সে ফারসি ও উর্দু ভাষার প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশে এ ভাষার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ নেই। ফারসি সাহিত্যেও জগতখ্যাত দার্শনিক ও সুফি সাধকদের মূল্যবান গ্রন্থাদি এখনও পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়েছে। এসব গ্রন্থ পাঠদান যদি নিতান্ত জরুরি হয়, তবে তা বাংলায় ভাষান্তর করে পাঠদানের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
কওমি মাদ্রাসার সর্ব স্তরে উর্দু এখনও শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম ও বাহন হয়ে আছে। ভাবতে অবাক লাগে, এখনও নাকি কোনো গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়নি। দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকারী বুজুর্গগণ ও শিক্ষার্থীরাও উর্দু ভাষাভাষী ছিলেন। সঙ্গত কারণেই এ কোর্সটি তখন উর্দুতে প্রণীত হয়েছিল। ভাষা হিসেবে একমাত্র আরবি ছাড়া অন্য সব ভাষা আল্লাহপাকের কাছে সমমর্যাদাসম্পন্ন এবং এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ নিজ নিজ কওমের কাছে মাতৃভাষায় দ্বীন প্রচারের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। সব আসমানি কিতাব নবী-রাসূলদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের হৃদয়ের ভাষা। এ ভাষায় মনের আবেগ, সুখ-দুঃখ, ওয়াজ-নসিহত, দাওয়াত ও তাবলীগ যত সহজ ও কার্যকর, একটা বিদেশি ভাষায় তা কি এত সহজ? কওমি মাদ্রাসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ওয়াজ-নসিহত, দাওয়াত তাবলীগ এবং প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত। এ খেদমত কি উর্দু ভাষার মাধ্যমে সম্ভব? এদেশে জীবনে মরণে, কথাবার্তায়, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, দৈনন্দিন জীবন, পারিবারিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র বাংলা ছাড়া উর্দু বা ফরাসির কোনো প্রয়োগ নেই। একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে মাতৃভাষায় বিদ্যার্জন যত সহজ, অন্য কোনো বিদেশি ভাষায় তা তত সহজ নয়। সারা জীবন উর্দু ভাষায় জ্ঞানচর্চাকারী সর্বজনস্বীকৃত বুজুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুরকে দেখেছি, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বাংলায় বক্তৃতা দিতে। তিনি কত অসহায়। একটা বিদেশি ভাষা শিক্ষায় যে মেধা, প্রতিভা ও সময়ের অপচয় হয় তা বাংলা ভাষায় এলমেদ্বীন শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করলে একজন শিক্ষার্থী আরও তরক্কী করতে পারবে। সুতরাং মাদ্রাসার সকল স্তরের কিতাবাদি বিজ্ঞ ওলামাদের দ্বারা বোর্ড গঠন করে বাংলা ভাষায় ভাষান্তর করে পাঠদানের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
কওমি মাদ্রাসার এ কোর্সে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ইংরেজি এখন আন্তর্জাতিক ভাষা। কম্পিউটারের এ যুগে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির চরম উন্নতির ফলে দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি গোষ্ঠী এখন প্রতিবেশীর মতো বসবাস করছে। মুসলমানরা ইসলামের একাত্ববাদ, ধর্মীয় উন্নত জীবনাদর্শ, শিষ্টাচার, উদারতা ও মহানুভবতা উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পারে। তা সম্ভব কেবল আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজির মাধ্যমে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দুনিয়ার তথ্যসন্ত্রাসীদের অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্যও প্রয়োজন ইংরেজি ভাষাজ্ঞান।
বর্তমান শতাব্দী ইসলামী জাগরণের শতাব্দী। সারা দুনিয়ায় ইসলামী জাগরণের আলামত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর সমগ্র অমুসলিম বিশ্ব মুসলিম নিধনযজ্ঞে প্রকাশ্যে একজোট হলেও সারা দুনিয়ায় অমুসলমানরা ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। তারা ইসলামের সর্বজনীন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলামে দাখিল হচ্ছে। তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে ইংরেজির বিকল্প নেই। পরাধীন ভারতে এক সময় একশ্রেণির অদূরদর্শী আলেম ইংরেজি শিক্ষাকে কুফুরি বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরে তারা তাদের এ ভুল বুঝতে পেরেছিলেন।
সুতরাং কওমি মাদ্রাসা কোর্সে দ্বীনি বিষয়ের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কওমি মাদ্রাসা কোর্সে জীবন ও জগতের অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ সম্পূর্ণ অবহেলিত ও উপেক্ষিত। শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক তৈরির জন্য এ কোর্স। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এ যুগে জীবন সংগ্রামের প্রতিযোগিতায় এ কোর্সে ফারেগ আলেমগণ টিকে থাকতে পারছেন না। এ শিক্ষায় কেবল ধর্মীয় বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকায় কর্মক্ষেত্রের সকল দ্বার তাদের জন্য রুদ্ধ। অথচ ইসলাম ধর্মের মূল কথা হলো ধর্ম ও কর্মের সমন্বয় সাধন। ইসলাম দুনিয়াকে তরক করতে বলেনি। পরনির্ভরশীলতা পরিত্যাগ করে স্বাবলম্বী হয়ে সম্মানজনক জীবনযাপন করাই ইসলামের শিক্ষা।
সুতরাং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কোর্সে ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়সমূহ যেমন : বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান ও ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি এখন যুগের দাবি। অন্তত কাফিয়া পর্যন্ত এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
তাবলীগ জামাতের দ্বীনি মেহনতের ফলে ইংরেজি শিক্ষিত, বিত্তবান ও সমাজের উঁচু শ্রেণির মধ্যে দ্বীনি শিক্ষার আগ্রহ বাড়ছে। ফলে দেশে অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠছে। এসব মাদ্রাসায় দেশ পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন হাজার হাজার প্রখর মেধাবী তরুণও ভর্তি হচ্ছে। এদের দ্বীনি এলেম ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষিত করে দেশ, জাতি ও ইসলামের বৃহত্তর খেদমতের উপযোগী করে তোলা যায়। দেশে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকা দরকার, যা দ্বারা এমন লোক তৈরি হবে যারা মসজিদের ইমামতিও করতে পারেন, আবার সমাজের কর্ণধার হয়ে দেশ ও জাতির নেতৃত্বও দিতে পারেন। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহ একই বোর্ড ও একই কোর্সের আওতায় আনয়ন জরুরি। দেশে এখন বিভিন্ন মাদ্রাসায় বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে। অনেক মাদ্রাসায় যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে দ্বীনি বিষয়সমূহকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ মাদ্রাসা দেড়শ বছরের প্রাচীন দেওবন্দের কোর্সটিকে আঁকড়ে ধরে আছে। সাধারণ শিক্ষিত ও বিত্তবানদের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি আগ্রহের সুযোগে অনেকে আবার ব্যয়বহুল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে মনগড়া সংক্ষিপ্ত কোর্স চালু করে দিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা লুটছে। অনেকে ইংলিশ মিডিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে।
দেশের সব মাদ্রাসাকে একই বোর্ডের আওতায় এনে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সনদপত্র প্রদান প্রথা চালু করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হবে। কর্মক্ষেত্রে মেধা ও প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন ও যাচাই করা সহজ হবে।
অনেকে মনে করেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসাসমূহে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকায় পরহেজগার, দ্বীনদান ও আমলী আলেম তৈরি হচ্ছে না, এ ধারণা ঠিক নয়। প্রচলিত কোর্সের জন্য নয় বরং সেখানকার দ্বীনি পরিবেশই এ জন্য অনেকটা দায়ী। মাদ্রাসাগুলো  অনাবাসিক হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আমল ও আখলাক সঠিকভাবে গড়ে উঠছে না। গত কয়েক বছর ধরে এসব মাদ্রাসায় সহশিক্ষা চালু এবং মহিলা ও হিন্দু শিক্ষক নিয়োগের বিধান করে এ ধর্মীয় শিক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। দেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহ এখন একমাত্র ভরসাস্থল। এ মাদ্রাসাগুলোর অধিকাংশ আবাসিক হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থীরা একদল দ্বীনদার আমলী আলেমের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরহেজগার ও হক্কানী আলেম হিসেবে গড়ে উঠছে। ফলে পরবর্তী জীবনে প্রতিকূল পরিবেশেও পথভ্রষ্ট হতে দেখা যায় না। আজকাল তাবলীগ জামাতের দ্বীনি পরিবেশের দ্বীনি মেহনতে অনেক ইংরেজি শিক্ষিত, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার হয়ে উঠছে।
লেখক : মো: খায়রুল ইসলাম
সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা
গফরগাঁও, ময়মসিংহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আতোযার হুসাইন ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ৭:৪২ এএম says : 0
আপনার প্রচেষ্ঠার সঠিক মূল্যায়ন সমাজ, দেশ ও জাতির সঠিক উন্নয়ন
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন