শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। কেননা এটি পবিত্র আমানত। প্রতিটি নাগরিকের এ আমানত রক্ষা করা উচিৎ। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেন যে, তোমাদের আমানতগুলো প্রাপকের কাছে পৌছে দাও।’ (সুরা নিসা- ৫৮)
পেয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, “লা ঈমানা, লিমান লা আমানাতা লা”। অর্থাৎ- ‘যার আমানতদারী নেই, তার ঈমান নেই’। (মুসনাদে আহমদ) রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে প্রিয় নবী সা: বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী)
রাষ্ট্রীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পাহাড়, মাটি, বন, বালি, আরো যে কোন সম্পদ যথাযথ ব্যবহার না করলে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হবে। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’। (বনী ঈসরাইল- ২৭)
আমাদের দেশে রয়েছে অনেক সরকারি খাস জমিন, যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে অবৈধ স্থাপনা, পাহাড় কাটা, বন উজাড় করা, নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের শামিল। নবী মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে, এক বিঘা জমি দখল করে, কিয়ামতের দিন ৭ স্তবক জমিন, তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। (আল হাদীস)
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা কবিরা গোনাহ। এর ফলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘ যারা আত্মসাৎ করে, তারা কিয়ামতের দিন আত্মসাৎকৃত সম্পদসহ উপস্থিত হবে। আর প্রত্যেকে তার উপার্জিনের ফল ভোগ করবে’। (আল কুরআন)
সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজায় এসেছে, হজরত যায়েদ ইবনে খালিদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত, “খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে সে মারা গেলে, রাসূলে কারিম সা. তার জানাযা পড়াননি। বরং বললেন, সে সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাসী করে তাতে একটি রেশমি বস্ত্র পেয়েছিলাম।
সহীহ মুসলিম ও বুখারী শরীফে বর্ণিত, একবার রাসূল সা. ইবনুল লুতবিয়া কে বায়তুল মালের অর্থ আদায়ের জন্য নিয়োগ করেন। তিনি ফিরে এসে আদায়কৃত অর্থগুলো দু’ভাগে ভাগ করে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! এগুলো রাষ্ট্রের সম্পদ, আর এগুলো আমার সম্পদ। যা মানুষ আমাকে হাদিয়া দিয়েছে। তার কথা শুনে রাসূল সা. খুব রেগে গেলেন। তিনি সাহাবাদের বললেন, তোমাদের কাউকে আমি সদকা আদায়ের জন্য পাঠালে, সে ফিরে এসে বলে, এগুলো রাষ্ট্রের আর এগুলো আমার সম্পদ, যা মানুষ আমাকে হাদিয়া দিয়েছে। তার চিন্তা করা উচিৎ, যদি সে বাড়িতে বসে থাকতো, তাহলে মানুষ তখন তাকে হাদিয়া দিতো না।

রাসূল সা. বলেন, আল্লাহর কসম! যারা রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করবেনা, আমানতের খেয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন তারা উট কাঁধে নিয়ে উঠবে। সে চিৎকার করে আমার কাছে সাহায্য চাইবে, কিন্তু সে দিন আমি তার কোনো সাহায্য করবো না।
আলোচ্য কুরান ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি একটি বিশাল আমানত।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অমাদের সবলকে, রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমীন!
নফসের মারাত্মক একটি ব্যাধির নাম লোভ। লোভ মানুষকে অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। নিমজ্জিত করে তাকে পাপসাগরে। একজন লোভী কখনো সুখী হতে পারে না। সুখের সব দ্বার রুদ্ধ করে দেয় এ মারাত্মক রোগটি। কেড়ে নেয় তার জীবন থেকে সুখ-শান্তি।শুধু তাই নয়,লোভী কখনো আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না; বরং উল্টো তাঁর দেয়া নেয়ামতের চেয়ে বেশি কিছু আকাঙ্ক্ষা করে । এমনকি একটা আশা পূরণ হতে না হতেই সে আরেকটা চেয়ে বসে।এভাবেই চলতে থাকে লোভের চক্র। লোভ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন এ লোভের চক্র থেকে বের হয়ে আসা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ও সে আকাঙ্ক্ষা করে,আমার মৃত্যুটা যেন জাঁকজমকপূর্ণ হয়, মৃত্যুসংবাদে যেন নেমে আসে মানুষের ঢল।আমার জানাযাকে যেন বলে -- ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জানাযা।
লোভী ব্যক্তি সম্পদ অর্জন করে ক্রয় করে :মানসিক অশান্তি, ব্যস্ত হৃদয়,পরকালের কঠিন হিসাব। আর একজন কৃতজ্ঞ দরিদ্র ব্যক্তি ক্রয় করে : আত্মিক প্রশান্তি, হতাশামুক্ত অন্তর,পরকালের সহজ হিসাব। লোভের নিন্দায় অসংখ্য হাদিস বিবৃত হয়েছে। যার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত,প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন, যদি আদম সন্তানের জন্য স্বর্ণ ভরা একটা উপত্যকা' থাকে, তবুও সে তার জন্য দু'টি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতীত অন্য কিছুতেই ভরবে না। তবে যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। (সহিহ বুখারি : ৬৪৩৯)।
মানুষ বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে তার পাপরাশিগুলো কমে যায়;কিন্তু লোভ এমন একটি ব্যাধি, যা দিন দিন বাড়তে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যায়; কিন্তু দু'টি ব্যাপারে যুবকই থাকে :বেঁচে থাকার লোভ এবং সম্পদের ভালোবাসা। (জামে তিরমিজি : ২৩৩৯)।
লোভ বহুপাপের জনক। এ লোভের কারণেই মানুষ এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে।বোনদের প্রাপ্য অংশ মেরে খায়। প্রতিপক্ষকে খুন করে ক্ষমতা দখল করে। এ লোভ কতটা ভয়ংকর, সে বিষয়টি প্রিয়নবি (সা.) একটি হাদিসে দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেন -কা’ব ইবনে মালিক আল-আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দু'টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে তা যতটুকু ক্ষতি করতে পারে না, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে তার ধর্মের। (জামে তিরমিজি : ২৩৭৬)।
এ লোভের কারণে পূর্ববর্তী উম্মত ধ্বংস হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্রের ভয় করি না। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের উপর দুনিয়া এরূপ প্রসারিত হয়ে পড়বে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর প্রসারিত হয়েছিলো। আর তোমরা ও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিলো। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছে।’ (সহিহ বুখারি : ৩১৫৮)।
লোভ-লালসা মানুষের হীনতম একটি বৈশিষ্ট। ভাই-বোনের মাঝে ধন-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, পাড়া-পড়শীদের সঙ্গে মামলা-মকদ্দমা ইত্যাদি। এ-সবকিছু লোভেরই ফসল। ধারণ ক্ষমতার বাইরে মানুষ কিছু খেতে পারে না, করতে পারে না। এসব জানা সত্ত্বেও মানুষ অতিরিক্ত পাওয়ার নেশায় কত রকম ধান্দার পেছনে যে জীবন নষ্ট করে দেয়, তা আমাদের চারপাশের মানুষকে দেখলেই বুঝা যায়। যার কপালে যতটুকু লেখা আছে,ততটুকু তার কাছে আসবেই।এর জন্য অযথা লোভ করতে হবে না। জড়াতে হবে না তাকে নানারকম অপকর্মে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন