বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, কিন্তু শ্বাশত এই বাণীর মতো বন্যরা এখন আর বনে থাকতে পারছে না। তাদের আবাসস্থল দখল করে মানুষ চাষাবাদ করছে। কোথাও বা নির্বিচারে গাছপালা কেটে বন ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে পরিবেশের যেমন মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি বন্যপ্রাণিদের জীবনধারণও হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে বন ধ্বংস করায় বন্যহাতি তাদের আবাসস্থল যেমন হারাচ্ছে, তেমনি চরম খাদ্য সঙ্কটও তৈরি হচ্ছে। ফলে খাদ্যের সন্ধানে বন্য হাতির পাল লোকালয়ে ছুটে আসছে। আর তখনই ঘটছে বিপত্তি। হাতির সাথে শুরু হচ্ছে মানুষের যুদ্ধ। বলা যায় জীবন আর জীবিকার টানাপড়েনে হাতি এখন মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় হাতির বিচরণ। শেরপুর জেলার সীমান্ত ঘেঁষা তিনটি উপজেলা শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে শতাধিক বন্যহাতির বাস। এ ছাড়া, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজারের টেকনাফ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়া এবং সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে বন্য হাতির বিচরণ রয়েছে। শেরপুর সীমান্তের বনাঞ্চল নির্বিচারে গাছ কেটে উজার করা হচ্ছে। বন বিভাগের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গাও স্থানীয়রা দখল করে চাষাবাদ করছে। অন্যদিকে টেকনাফে হাতির বিচরণ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠায় হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণি জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে আসলেই হাতির প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। একই সাথে হাতির আক্রমণে মানুষও মারা যাচ্ছে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ২ বছরে দেশে প্রায় ৩৮টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত বছর নভেম্বরে সাতটি হাতির মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুত বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে মহাবিপন্ন এ প্রাণীটি। অন্যদিকে হাতির আক্রমণে গত দুই দশকে কমপক্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেরপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৯০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। বন্যহাতির আক্রমণে শত শত ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সহস্রাধিক একর জমির ফসল, সবজি ক্ষেত ও ফল বাগান নষ্ট হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে হাতির আক্রমণে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ইনকিলাবকে বলেন, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে বন্যহাতির জন্য শেরপুর জেলার সীমান্তে অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া হাতির আক্রমণ ঠেকাতে তারা জানান, স্থানীয় জনসাধারণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালে লোকালয়ে হাতির হামলা ঠেকাতে ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিং (বৈদ্যুতিক বেড়া) এর পাইলট (পরীক্ষামূলক) প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রঙ্গামাটিতেও এ ধরনের প্রকল্প আছে। সব মিলিয়ে সরকার বন্যপ্রাণির নিরাপদ আবাস এবং একই সাথে মানুষের নিরাপত্তারও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তবে সরকারের নেয়া এ প্রকল্পের সুফল জনগণ পাচ্ছে না। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সোলার ফ্যান্সিং বা বৈদ্যুতিক বেড়া কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। স্থানীয় লোকজন বনের ভেতর হাজার হাজার গরু চড়িয়ে সোলার ফ্যান্সিংগুলো ধ্বংস করে ফেলেছে। হাতির চলাচলের পথে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে সহনীয় পর্যায়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহযুক্ত তারের বেড়া দেওয়া হয়। যার স্পর্শে এলে শক লেগে সরে যাবে হাতি। কিন্তু হাতির মনোদৈহিক কোনো ক্ষতি হবে না। এই কৌশলের নাম ‘সোলার ফ্যান্সিং’। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্প এখন কোনো কাজেই আসছে না।
শেরপুরের সীমান্ত ঘেঁষা তিনটি উপজেলার বনাঞ্চলে শতাধিক বন্যহাতির বসবাস। এসব বন্যহাতির সুরক্ষায় ওই এলাকায় অভয়ারণ্য তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্থানীয়রা আস্তে আস্তে জায়গা দখল করে নেয়ায় বনাঞ্চলটি সংকুচিত হয়ে গেছে। এতে আবাসস্থল হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, জীবিকার আর কোনো উপায় না থাকায় তারা বনের জমিতে চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ নিয়ে বন কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য নেয়া হচ্ছে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এছাড়া হাতিকে বনে রাখার জন্য সরকারের সুফল প্রকল্পের আওতায় বিপুল পরিমাণ ঔষুধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। এখন জনসাধারণকে বনের জ্বালানি কাঠ ও আগাছাও কাটতে দেয়া হচ্ছে না। এর ফলে ওই এলাকা আরো গহিন বনে পরিণত হবে। সেখানে থাকবে ফুড ফেস্টার বাগান (তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ), বাঁশ, কলা, কাঁশফুলের বাগান, আমলকি, হরতকি, বহেড়া ও চাপালি জাতীয় গাছ। এক সময় বনে আর হাতির খাবারের অভাব হবে না। পাশাপাশি হাতির খাবারের সংস্থান আরো স্থায়ী রূপ দেয়ার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। চিন্তাভাবনা চলছে।
শেরপুরের বন কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, বন্যহাতির দল মাঝেমধ্যে এলাকায় হামলা চালিয়ে ফসল ও সবজি বাগান খেয়ে সাবার করে দেয়। ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলে। এ কারণে এলাকার মানুষ মানুষ হাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। লোকবল কম থাকায় হাতি-মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ বলেন, পাহাড়ি বিভিন্ন বনের গভীরে গাছ কেটে সাফ করে হাতির বিচরণ ক্ষেত্র দখল করে সবজি চাষ করছে স্থানীয়রা। হাতিরা যেন সবজির ক্ষেত নষ্ট করতে না পারে, সেজন্য তারা ক্ষেতের চারপাশে জিআই তারের বেড়া দিয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তারগুলো এতোটাই সুক্ষè যে কারও পক্ষে এক হাত দূর থেকে দেখাও সম্ভব নয়। সেই বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়েই মারা যাচ্ছে অনেক হাতি। গত বছর নভেম্বরে যে পাঁচটি হাতি মারা গেছে, সেগুলো এভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে মহাবিপন্ন এ প্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।
বন্যপ্রাণি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাÑ আইইউসিএন-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের এশীয় প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ বয়সি হাতির সংখ্যা ২৫০টির কম। এজন্য এই প্রাণীটিকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বর্তমান আইনে হাতি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি ২ থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ থেকে ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। সেইসঙ্গে হাতির হামলায় কেউ মারা গেলে ৩ লাখ টাকা, আহত হলে ১ লাখ টাকা এবং ফসলের ক্ষতি হলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের বিধানও রয়েছে। কিন্তু এই মামলার কোনো প্রয়োগ নেই বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন