শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চিনিশিল্পের উজ্জ্বল উদ্ধার কাম্য

| প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০২ এএম

দেশে ১৫টি চিনিকল রয়েছে, যার ৬টি এখন বন্ধ। সচল ৯টি চিনিকলে ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে। চিনিকলগুলোর সাকল্য উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হলেও চিনি উৎপাদিত হয় ৮০ হাজার টনের মতো। দেশের সাংবাৎসরিক চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। এই বিপুল চাহিদার বিপরীতে এত সামান্য উৎপাদন হতাশাজনক। এমন একটা সময় ছিল যখন চিনি উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় উদ্বৃত্ত চিনি রফতানিও করা হয়েছিল বলে জানা যায়। চিনি উৎপাদনে স্বয়ংভরতা এখন গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। চিনির ক্ষেত্রে দেশ সম্পূর্ণ পরনির্ভর হয়ে পড়েছে। চাহিদার ৯৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। একদার স্বয়ংভরতা কীভাবে সম্পূর্ণ পরনির্ভরতায় রূপ লাভ করলো, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত, চিনিশিল্পের উন্নয়নে তেমন কোনো নজর দেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, তিনটি চিনিকল ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। বাকীগুলো ৫০ ও ৬০-এর দশকে। সঙ্গতকারণে চিনিকলগুলোর যন্ত্রপাতি পুরানো ও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উপযুক্ত প্রতিস্থাপন হয়নি। এতে উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে। তৃতীয়ত, দেশে সামগ্রিকভাবে আখের উৎপাদন কমেছে। বছরের পর বছর আখের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা আখচাষ কমিয়ে দিয়েছে। এখন প্রতিবছরই উৎপাদন মওসুমে আখের সংকটে পড়ে চিনিকলগুলো। একারণে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত উৎপাদনে থাকতে পারে না। প্রতিটি চিনিকলের কমান্ড এরিয়াতেও এখন আখচাষ কমে গেছে। চতুর্থত, চিনিকলগুলো অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এদের প্রশাসনও মাথাভারি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব প্রকট। আয়ের চেয়ে ব্যয় অত্যাধিক এবং লোকসান সঙ্গের সাথী। দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনিকল ছাড়া সব চিনিকলই লোকসানে চলছে। পঞ্চমত, চিনি উৎপাদনে আত্মনির্ভর হওয়ার পথে কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের বাধাও দায়ী। বর্তমানে বেশ কিছু চিনির রিফাইনারীশিল্প দেশে রয়েছে। বিদেশ থেকে ক্রুড আমদানি করে এসব রিফাইনারীতে চিনি বানানো হয়। এই রিফাইনারীশিল্পের কারণে চিনিকলগুলো উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। এর পেছনে রিফাইনারীগুলোর মালিকরা কলকাঠি নাড়ছে বলে অভিযোগ আছে।

চিনিকল বৃহৎ শিল্পের অন্তর্গত। বিশাল এলাকা জুড়ে এর প্রতিষ্ঠা। প্রতিটি চিনিকলকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো শহর গড়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিক, তাদের বাসস্থান, ব্যারাক, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন, নানা ধরনের ছোটবড় স্থাপনাÑ সবমিলে একটা এলাহী কারবার। এই বিশাল জায়গা, যন্ত্রপাতি, যান, স্থাপনা এখন অধিকাংশ সময় কাজে লাগে না। অথচ, উদ্যোগ নিয়ে চিনিকলগুলো উৎপাদনে ব্যস্ত ও লাভজনক করা সম্ভব। ভারতে চিনিশিল্পের ব্যাপক বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। সেখানকার অনেক চিনিকল ৫০-৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো পূর্ণ উৎপাদনসক্ষম। এটা সম্ভব হয়েছে পুরানো যন্ত্রপাতির স্থলে নতুন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করার ফলে। ভারতে মাড়াই মওসুমের নির্ধারিত সময়ের পরও চিনিকলগুলো সচল থাকতে দেখা যায়। এদের উৎপাদন ক্ষমতাও আমাদের চিনিকলগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আখের উৎপাদন সেখানে প্রচুর। মানও অনেক উন্নত। রসের প্রচুর্য ও মানের ওপর চিনির উৎপাদন নির্ভর করে। ভারতে যেভাবে চিনিশিল্পকে গুরুত্ব দেয়া হয়, গুরুত্ব দেয়া হয় আখচাষকে, আখের গবেষণাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হলে আমাদের চিনিশিল্প কখনোই এমন বেহাল অবস্থায় পতিত হতো না। ভারত বিশাল দেশ বটে। অথচ, দেশটি চিনি উৎপাদনে স্বয়ংভরই নয়, চিনি রফতানিকারী দেশও। এবার আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সবদেশেই চিনির দাম বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতে চিনির বাম্পার উৎপাদনে আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরা কিছুটা হলেও স্বস্তি দেখছেন। বাংলাদেশের সর্বত্র আখ উৎপাদিত হয়। এর মাটি আখ উৎপাদনের জন্য উপযোগী। ভারতে আখ উৎপাদনক্ষম জমির পরিমাণ অনেক। সেখানে তা কাজে লাগিয়ে চিনির জাতীয় চাহিদা পূরণ করেও রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে দেশেটি। পক্ষান্তরে আমরা সকল সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমদানি করে চাহিদা পূরণ করছি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা এবং এমন নজিরবিহীন ব্যর্থতা আর কী হতে পারে!

৬টি চিনিকল বন্ধ থাকার কারণে তাদের যন্ত্রপাতি, যান, ভবন, স্থাপনা নষ্ট হচ্ছে। লোকবল অনিশ্চিত অবস্থায়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তরফে চিনিকলগুলো অবিলম্বে চালু করার দাবি জানানো হলেও সরকারের এদিকে নজর নেই। শোনা যাচ্ছে, এগুলো পর্যায়ক্রমে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এত বৃহৎ মিল-কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া কতটা উচিৎ ও সঙ্গত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। অনেক স্বনামধন্য শিল্পকারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার ফল একেবারেই ভালো হয়নি। শেষ পর্যন্ত শিল্পকারখানাই হারিয়ে গেছে। তার জমি-সম্পত্তি লোপাট হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রাখলে চিনিকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া সমীচীন হবে না। তারচেয়ে এই শিল্পের উন্নয়ন-আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদনসক্ষমতা বাড়িয়ে লাভজনক করাই হবে উত্তম পদক্ষেপ। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন, দক্ষ লোকবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, অনিয়ম-দুর্নীতি দূর- এসব করা কঠিন নয়। সরকার দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে এক-দু বছরের মধ্যে এ শিল্পের প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও বিকাশ সম্ভবপর হতে পারে। এতে সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে, চিনি উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভর হবে এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমরা আশা করবো, সরকার এদিকে সুনজর দেবে এবং যথাপ্রয়োজন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন