শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

আফগান নারী অধিকারের লড়াইয়ের ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১:৪৭ পিএম

শতক পেরিয়ে আফগান নারীদের বারবার শুনতে হয় কী করবে, কী করবে না৷ নারীদের কণ্ঠস্বর কখনোই খুব একটা জোরালো ছিল না আফগানিস্তানে৷ শাসক এবং গোষ্ঠীনেতাদের মধ্যে নারীদের অধিকার নিয়ে বিতর্ক চলছেই৷

কেমন আছেন আফগানিস্তানের নারীরা৷ আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার আগে ওয়ার্দাকের রাজধানী ময়দান-সেহরের সাবেক মেয়র ছিলেন জারিফা ঘাফারি৷ তালেবান দেশ দখলের সময় আফগানিস্তান থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন এই নেত্রী৷ তার কথায়, ‘‘বর্তমানে আফগান নারীদের এ দেশে কী পরিমাণ ঝুঁকি রয়েছে তা আমি জানি৷ খুব খারাপ পরিস্থিতি৷ আত্মগোপনের জায়গা খোঁজা কিংবা মৃত্যুর অপেক্ষা-এই তো অবস্থা এ দেশের মেয়েদের৷’’ কোনও নারীকে আর মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে দেখা যায় না৷

জারিফার বন্ধুরা তাকে জানিয়েছেন, তিনটি শিশুকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছে তাদের মা৷ ওদের দেখার ক্ষমতা নেই সে মায়ের৷ তার কারণ একাই সন্তানদের মানুষ করছেন এমন মায়েদের কাজ নেই৷ রুটিরুজির ভার যেসব পরিবারে নারীদের তারা আর খেতে পাচ্ছে না৷ কারণ তালেবান নারীদের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷

বিজ্ঞাপন এবং টেলিভিশন সহ সমস্ত মাধ্যমে নারীদের মুখ দেখানো নিষিদ্ধ করেছে তালেবান৷ মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ পরিবারের কোনও পুরুষ ছাড়া কোনও নারীর বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই৷ সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমা আহমেদ ঘোষ ২০০৩ সালে ‘আ হিস্ট্রি অফ উইমেন ইন আফগানিস্তান’-এ একটি স্টাডিতে দেখিয়েছেন, ১৯০০ সাল থেকে নারীদের অধিকার আফগানিস্তানের শাসকদের কাছে একটা জরুরি ব্যাপার৷

১৯২০ সাল নাগাদ কিন্তু দেশের স্বার্থে নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে৷ হাবিবুল্লাহের মৃত্যুর পর তার ছেলে আমানুল্লাহ খান দায়িত্ব নেন৷ তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশদের উৎখাত করেন তিনি৷ কামাল আতাতুর্কের আমলে তুরস্ক যেমন ছিল, তা দেখে তিনি আধুনিকীকরণে উদ্যোগী হন৷ এক বিবাহ, শিক্ষার প্রসার এবং আপাদমস্তক ঢাকা বোরখা তুলে দেওয়ার মতো বদলগুলি শুরু করেন৷ ফলে নারীদের অধিকার খানিকটা হলেও সুরক্ষিত হওয়া শুরু হল৷

যদিও অনেক গোষ্ঠীর নেতারা চরম বিরোধিতা করেন আমানুল্লার এসব প্রস্তাবের৷ বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ২১ করে এক বিবাহ প্রথা চালুর বিষয়ে তীব্র আপত্তি ছিল তাদের৷ উপজাতীয় নেতাদের চাপে আমানুল্লাহ দেশ ছেড়ে ইউরোপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন৷

রাজতন্ত্রের অবসানের পর এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়নমূলক সহায়তা বেড়ে যাওয়ার ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীশক্তির চাহিদাও বাড়ে৷ চিকিৎসা, শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন আফগান নারীরা৷ ১৯৭০ নাগাদ, নারী অধিকার রক্ষায় একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ নারীদের বিবাহের বয়স বৃদ্ধি এবং শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়৷ আবারও উপজাতি নেতারা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন৷

হুমা আহমেদ ঘোষ লিখছেন, পরে মুজাহিদদের উত্থান ঘটে৷ তারপর এল তালেবান৷ চিরকাল ধরে চলে আসা ইসলামি বিধি কার্যকর করা এবং নারীদের ঘরবন্দি করায় জোর দেওয়া বেড়ে গেল৷ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের নারীরাও ওয়েস্টার্ন বা আধুনিকদের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ মনে করেন৷

চরম পুরুষতান্ত্রিক দেশ আফগানিস্তান৷ মিউনিখে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল কমপারিজনস অ্যান্ড মাইগ্রেশন রিসার্চে কর্মরত অর্থনীতিবিদ ব্রিটা রুড লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কাজ করছেন৷ তার মতে, ‘‘বাইরে গিয়ে নারীদের কাজ এখানে সমর্থনযোগ্য নয়৷ শ্রমের বিভাজন একেবারে প্রাচীন আমলের মতো৷ নারীরা বাড়ির সমস্ত কাজ করে৷ পুরুষেরা বাইরে গিয়ে কাজ করে৷ শিশু এবং বয়স্কদের যত্ন নেয় নারীরাই৷ এই রীতি আফগান পুরুষদেরও পছন্দ৷’’

সংবাদসংস্থা রয়টার্স জাতিসংঘের একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে জানায়, মাত্র ১৫ শতাংশ আফগান পুরুষ বিশ্বাস করে, বিবাহিতাদের বাইরে গিয়ে কাজ করা উচিত্৷ দুই তৃতীয়াংশের দাবি, আফগান নারীদের একটু বেশিই স্বাধীনতা দেওয়া হয়৷ পরিবারের মূল্যবোধ এবং নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কিছু করাকে অনেক নারী তার পরিবারের জন্য অসম্মানের বলে মনে করেন৷ নারীদের আচরণের প্রতি এত মনোযোগ, তাদের ঘরে আটকে রাখার মূল কারণ সেই পরিবারের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা৷

রুড জানাচ্ছেন, মূল্যবোধ পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত হয় আফগান মুলুকে৷ নারীরা সেই নিয়ম শুধু অনুসরণ করবে তা না হলে পরিবারের সম্মানে প্রভাব পড়বে৷ আফগানিস্তানে এখনও অনার কিলিং হয়৷ উপজাতিরা নিজস্ব নিয়মকানুন বানিয়েছে৷ তারা সরকারি আইনগুলিকে বাতিল করে নিজেদের তৈরি করা আইনে শাস্তি দিতে চায়৷ সুদূর ভবিষ্যতে থাকলেও আগামী দিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা নেই।

সাবেক মেয়র জারিফা বলছেন, আরও বেশি করে নারীবিরোধী আইন আনা হচ্ছে তালেবান জমানায়৷ আফগান সংস্কৃতি ৬০-৭০ বছরের যুদ্ধের আগে দারুণ ছিল৷ নারীদের অধিকার সুরক্ষিত ছিল৷ তার নিজের দাদীর বয়স এখন ১০০৷ তিনি জারিফাকে বলেন, তাদের সময় মেয়েরা পছন্দসই পোশাক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারত৷

জারিফার মতে, ‘‘আফগান সংস্কৃতি হল মালালা মায়ওয়ান্দির সংস্কৃতি, রাবিয়া বলখির সংস্কৃতি৷ ২০২০ সালে জালালাবাদে বন্দুকবাজেরা হত্যা করে মালালকে৷ বলখি ছিলেন দশম শতকের কবি৷ ক্রীতদাস প্রেমিক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছিলেন বলখি৷ কারণ তাদের বিয়েতে অনুমতি মেলেনি৷’’

ইসলামি সংস্কৃতিতে হিজাব পরার সময় স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি খেয়াল রাখতে হয়৷ এটি তালেবানের কঠোর নিষেধাজ্ঞার ঠিক বিপরীত৷ প্রেস এজেন্সি এএফপি জানুয়ারির শুরুতে রিপোর্ট করেছিল যে তালেবানের ধর্মীয় পুলিশ কাবুলের চারপাশে পোস্টার লাগিয়েছে৷ পোস্টারে নারীদের আপাদমস্তক আবৃত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷

জারিফার বক্তব্য, নির্বোধের মতো যারা ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করে, তারা বলে এটা করলে জাহান্নামে যাবে এটা করলে জাহান্নামে যাবে না৷ তালেবানের উপরে কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রগুলিকে বারবার আফগান মুলুকের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে হবে৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন