বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

‘আমি ট্রান্সজেণ্ডার, আর আমার প্রেমিক একজন স্ট্রেইট পুরুষ’

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০২২, ৪:১২ পিএম

ড্যানিয়েলা ম্যাকডোনাল্ড হচ্ছেন এমন একজন ট্রান্সজেণ্ডার নারী - যিনি পুরুষদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেন। ক্যালিফোর্নিয়ান ড্যানিয়েলা এখন ডাক্তারি পড়ছেন। তিনি বলছেন, প্রথম দিকে স্ট্রেইট অর্থাৎ বিপরীতকামী পুরুষদের সাথে প্রেম করাটা ছিল এক "ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।"

তবে গত আড়াই বছর ধরে তিনি একটি "স্থিতিশীল" সম্পর্কের ভেতর আছেন এবং এখন তার মনে হয় যে স্ট্রেইট পুরুষরা আস্তে আস্তে ট্রান্স-নারীদের সাথে প্রেম করাটাকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করতে শুরু করেছে। বিবিসির জেণ্ডার আত্মপরিচয় বিষয়ক সংবাদদাতা মেঘা মোহনের সাথে কথা বলেছেন ড্যানিয়েলা।

তিনি বলেন, রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি নিজেকে মোটামুটি রক্ষণশীল বলেই মনে করি। আমি চাই, একজনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, পরস্পরের সঙ্গী হওয়া, পরস্পরের জন্য ব্রেকফাস্ট বানানো, একজন মেডিক্যাল ছাত্রী হিসেবে পড়াশোনার চাপের মধ্যেও যে আমার পাশে থাকবে।

আমি স্যান ডিয়েগোতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমার অনলাইন প্রোফাইলে আমি নিজেকে বর্ণনা করতে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছি "ট্রান্সজেন্ডার নারী" - তা ছাড়া আমার ডেটিং প্রোফাইল আর দশজনের মতোই। আমি আমার জেণ্ডার আত্মপরিচয় গোপন করি না, কখনোই করিনি।

আমার বয়স যখন ২৬ বছর তখন আমি শারীরিক পরিবর্তন শুরু করি। কিন্তু আমি অনেক বছর ধরেই ড্যানিয়েলা নামে পরিচিত। আমি নারী হিসেবে আমার জীবনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছি। তবে মিডিয়ায় ট্রান্স মানুষদের নিয়ে যেসব বিতর্ক হয় তার সাথে আমি নিজেকে কখনো যুক্ত করিনি।

ট্রান্সরা কোন বাথরুমে যাবে বা আমাদের ক্ষেত্রে কী সর্বনাম ব্যবহৃত হবে - আমি এবং আমার ট্রান্স বন্ধুরা মিলে কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এসব বিতর্ক করি না। বেশিরভাগ তরুণতরুণী তাদের সম্পর্ক নিয়ে যেসব আলোচনা করে - আমরাও তা নিয়েই কথাবার্তা বলি। আমি যেহেতু এমন একজন নারী যে পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে - তাই আমি এমন একজন পুরুষের সাথেই সম্পর্কে জড়াতে চাইতাম যে নারীদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।

কিন্তু ডেটিং অ্যাপে কিছু পুরুষ যে আচরণ করেছে - আমি তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার ডেটিং প্রোফাইলে যেসব সরাসরি মেসেজ আসতো তার বেশিরভাগই ছিল অত্যন্ত বিশ্রী। হয়তো আমার ঘুম ভাঙলো, আর দেখলাম একটা মেসেজ এসেছে - তাতে আমাকে সম্বোধন করা হয়েছে "ট্র্যানি" বলে।

হয়তো ফোনটায় টুং করে শব্দ হলো, আর দেখলাম একটা বার্তা এসেছে - "তুমি তো একজন পুরুষ।" কেউ কেউ আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। পুরো একটা প্যারাগ্রাফ লিখে সবিস্তারে বর্ণনা করেছে ঠিক কিভাবে আমাকে হত্যা করা দরকার, তা নিয়ে তার অসুস্থ কল্পনার কথা ।

আরেক ধরনের পুরুষ আছে - যাদের এক ধরনের বিকৃত আগ্রহ আছে ট্রান্স নারীদের ব্যাপারে। এগুলো ঠিক উগ্র নয়, কিন্তু তারপরও আমার জন্য মানসিকভাবে যন্ত্রণাদায়ক। এরা আমাকে দেখে একটা বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষার বিষয় হিসেবে। সম্মানজনক সীমা রক্ষা করতে জানে না এরা।

আমাদের প্রাথমিক কথাবার্তার সময় আমাকে তারা প্রশ্ন করেছে আমার যৌনাঙ্গ নিয়ে, এবং জানতে চেয়েছে আমরা কি ধরণের যৌনমিলন করতে যাচ্ছি। অন্য কিছু পুরুষ আছে যারা দয়ালু এবং তারা আমার সাথে থাকতেও চেয়েছে। কিন্তু তাদের সাথে ডেটিং করাটা তার পরও ছিল একটা চ্যালেঞ্জ।

এ ধরনের লোকেরা যারা কাগজে-কলমে ভালো, কিন্তু তারাই আবার এটা ভাবতে লজ্জা বোধ করে যে - একজন ট্রান্স নারীর সাথে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাবে। এই লোকেরা আমাকে তার পরিবার বা বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় না। কেউ কেউ বলে, তাদের কর্মস্থলের বস যদি জানতে পারে যে সে একজন ট্রান্স নারীর সাথে ডেটিং করছে তাহলে তার চাকরি চলে যেতে পারে।

আমার কাছে মনে হতো - এগুলো হচ্ছে মজ্জাগত হয়ে যাওয়া হোমোফোবিয়া। এই পুরুষরা আমাকে একজন নারী হিসেবে দেখতে পারছিল না। তাদের পরিচিতজনরা তাদেরকে সমকামী মনে করুক এটাও তারা চায় না। আমার জন্যে এসব অভিজ্ঞতা ছিল কষ্টকর, খুবই কষ্টকর।

মাকি গিংগোইওন থাকেন ফিলিপিনে । তিনি তার পার্টনার সিরিল মাজুরকে নিয়ে "মাই ট্রান্সজেণ্ডার ডেট" নামে একটি ডেটিং ওয়েবসাইট পরিচালনা করেন। সিরিল একজন বিপরীতকামী বা স্ট্রেইট, এবং সিসজেণ্ডার - অর্থাৎ তিনি তার জন্মগত লিঙ্গপরিচয় কখনো পরিবর্তন করেননি।

মাকি বলছেন, ২০১৩ সালে এই সাইটটি যখন তিনি প্রথম চালু করেছিলেন, তখন খুব দ্রুতই তাতে ১৫ লাখ প্রোফাইল পেয়ে যান তারা। কিন্তু তাদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন খুবই কম। তবে গত আট বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা এখন কয়েকশ' থেকে বেড়ে ১২০,০০০-এ উঠেছে। অনেক স্ট্রেইট সিসজেণ্ডার পুরুষ - যারা ট্রান্স পার্টনার চান - তারা এখন আত্মবিশ্বাসের সাথেই তাদের ফটো পোস্ট করছেন। এমন অনেকে এতে সাইন আপ করেছেন যাদের বয়স ২০ বা ৩০-এর কোঠায়। এতে সদস্যদের গড় বয়সও নেমে এসেছে।

"আমরা ২০১৩ সালে এই সাইটটি চারু করেছিলাম যাতে ট্রান্সজেন্ডার নারী এবং সিসজেণ্ডার পুরুষরা একটা নিরাপদ জায়গা পান - যেখানে তাদের পরস্পরের সাথে অর্থপূর্ণ রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ মেলে" - মাকি বলছেন, "একজন ট্রান্সজেন্ডারের পক্ষে অনলাইনে ডেটিং করাটা সমস্যাপূর্ণ হতে পারে। অনলাইন স্পেসে ট্রান্সজেন্ডাররা একটা প্রশান্তি এবং সমমনা মানুষদের কমিউনিটি পেতে পারেন ঠিকই - কিন্তু এখানে কারো কারো অপমানজনক অভিজ্ঞতাও হতে পারে। তবে এটা বলতেই হবে যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। আমি আস্থার সাথেই বলতে পারি যে এ ধরনের সম্পর্কের সংখ্যা এখন বাড়ছে।"

আমার মনে আছে একবার এক ডেটিংয়ের সময় আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়া হলো। কথা ছিল যে আমরা সিনেমা দেখবো। তাকে যখন টিকেট কিনতে দেখলাম তখন আমি খুবই উৎফুল্ল হয়েছিলাম। আমার মনে হলো "এ লোকটি তো সত্যি চমৎকার এবং আমরা একটা সুন্দর টিপিক্যাল ডেটে যাচ্ছি।"

"তার পর আমরা যখন সিনেমা হলের ভেতরে গিয়ে বসলাম, আলো নিভে গেল, ছবি শুরু হবার আগে ট্রেইলার দেখানো শুরু হলো - তখন সে ঘুরে আমার দিকে তাকালো এবং বললো - "আমার মনে হচ্ছে আমি এটা পারবো না"- তার পর সে উঠে দাঁড়ালো এবং হল থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একা একাই বাড়ি ফিরলাম।"

"আমার মনটা একেবারেই ভেঙে গেল। আমি দেখলাম, একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে এবং আমি ক্রমাগত অপমানিত হচ্ছি। মনে হচ্ছে আমারই যেন কিছু একটা সমস্যা আছে। সেটা এমনই মৌলিক একটা কিছু - যার কারণে আমাকে কারো পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব নয়।"

আর তার পরই আমার পরিচয় হলো জশের সাথে। সে একটা ডেটিং অ্যাপে আমাকে বার্তা পাঠিয়েছিল। তখন থেকেই তাকে অন্যরকম লেগেছিল। জশ আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে ছিল।

সে এসেছে একটি বড় ফিলিপিনা-আমেরিকান পরিবার থেকে। সে যখন বুঝতে পারলো যে আমরা দু'জনই সম্পর্কটার ব্যাপারে সিরিয়াস - তখন সে তার পরিবারের কাছে আমার ব্যাপারে এবং আমার জেণ্ডার পরিচয় নিয়ে সব কিছু খুলে বলেছে। তার পরিবারের কাছে এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে জশ একটি ট্রান্সজেণ্ডার মেয়ের সাথে প্রেম করছে। তবে তারা ছিল খুবই আন্তরিক।

জশের আত্মীয়দের মধ্যে প্রথম যার সাথে আমার পরিচয় হয় সে হচ্ছে তার বোন। আমাকে আর জশকে একসাথে দেখে যে তার ভালো লেগেছে তা আমি তার মুখের ভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। পরের কয়েকমাসে আমার জশের পরিবারের সবার সাথেই সাক্ষাৎ হলো। জশের দাদু যখন প্রথম আমাকে দেখেছিলেন তখন তার প্রথম উক্তিই ছিল - "জশ, মেয়েটি তো দেখছি খুবই সুন্দরী।"

আমি জশকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীভাবে সে অন্যদের চাইতে এত আলাদা এবং খোলা মনের হতে পেরেছে। সে বলেছিল, তার বন্ধুমহলের মধ্যে একজন ছিল ট্রান্স নারী এবং সে তাকে কখনো তার জেন্ডারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেনি। যেহেতু সে আগে একজন ট্রান্সজেন্ডারকে দেখেছে তাই সেটা তার চোখ খুলে দিয়েছে।

জশ বলেছে, সে আমার সাথে ডেটিং করা এবং একজন সিসজেন্ডার নারীর সাথে ডেটিং করার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পায় না, এবং আমরা "স্বাভাবিক প্রেম"ই করছি। এটা আড়াই বছর আগের কথা। তখন থেকে আমরা এক সাথেই আছি। অন্য যে কোন যুগল যেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলে আমরাও তাই করি।

আমার বন্ধু মহল বেশ বড় এবং তাদের মধ্যে সব ধরনের সম্পর্কই আছে। তাদের তুলনায় আমার আর জশের সম্পর্কটাকে বলা যায় খুবই সনাতনী ধরনের - তার অর্থ যাই হোক না কেন। আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমাদের ক্যারিয়ারের কারণে অনেকটা সময় আমাদের পরস্পরের থেকে দূরে কাটাতে হয়।

জশকে সামরিক বাহিনীর ট্রেনিংয়ের জন্য মাসের পর মাস কাটাতে হয়। আর আমাকে মেডিকেল স্কুলের পড়াশোনার জন্য প্রতিদিন ১২ ঘন্টা কাটাতে হয়। তবে আমার আরেকটা উচ্চাভিলাষ আছে। আমার এক বান্ধবী হলো এভি মানুলাং - যে নিজেও একজন ট্রান্সজেণ্ডার এবং সে একজন নার্স।

আমরা চাই ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য একটা ডেটিং অ্যাপ চালু করতে - যাতে ট্রান্সজেণ্ডার নয় এমন মানুষরাও আসতে পারবে যারা ভিন্ন জেণ্ডার পরিচয়বিশিষ্ট মানুষদের গ্রহণ করতে রাজি । ট্রান্স নারীরা বাড়াবাড়ি রকমের যৌন সহিংসতার শিকার হয়। তাই আমরা এমন উপায় বের করছি যাতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। ভালোবাসা এবং মর্যাদার সাথে বাঁচার অধিকার সবারই আছে।

আমি ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম তখন টিভিতে জেরি স্প্রিংগার শো'র মতো অনুষ্ঠানে ট্রান্সজেন্ডাররা ছিল শুধুই বিদ্রুপের বিষয়। এখন আমাদের দেশে তরুণ অভিনেতারা আছে যারা খোলাখুলিভাবেই ট্রান্সজেন্ডার। টিভি শো ইউফোরিয়ার হান্টার শেফারের মতো লোকরা তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে কোন রাখঢাক করেন না। যখন আমি বড় হচ্ছিলাম তখন তারা ছিলেন না।

তবে এখন লোকে বিভিন্ন জেন্ডারের লোকদের নিজেদের মতো করে চলতে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছে। আমি জানি যে এর ফলে মানুষের মনে পরিবর্তন আসবে এবং আপনি ভবিষ্যতে আমার আর জশের মত আরো অনেক সম্পর্ক দেখতে পাবেন। আমি বলছি না যে ট্রান্সজেন্ডারদের সাথে ডেটিংয়ের ব্যাপারে সবাইকে উন্মুক্ত হতে হবে। কিন্তু সিস-ট্রান্স প্রেমের যে অস্তিত্ব আছে এবং এতে যে অন্যায় কিছুই নেই সেটা লোকের বোঝা দরকার।

আমার সম্পর্কটা এখনো সাধারণ ব্যাপার নয়, বরং একটা ব্যতিক্রম। কিন্তু পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে। বিশেষ করে জেনারেশন জেড এখন জেন্ডার বৈচিত্রের ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছে, এ ব্যাপারে তারা কোন রাখঢাক করছে না। টিকটকে একটা হ্যাশট্যাগ আছে সিসট্রান্সকাপল। সেখানে ভিউ-এর সংখ্যা এখন ৩৭ লাখেরও বেশি। এটা নিয়ে আমি খুবই উৎফুল্ল। সূত্র: বিবিসি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন