শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পুঁজিবাদের অনৈতিক প্রতিযোগিতায় আত্মঘাতী রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, গণতন্ত্রহীনতা, অর্থনৈতিক লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতির মচ্ছব, সামাজিক অবক্ষয়, তরুণ সমাজে মাদকাসক্তি অপরাধ প্রবণতা, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য-অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি প্রবণতাগুলো এখন আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে চরমভাবে বিদ্যমান। মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ এসব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এখন মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলেও গণবিরোধী পুলিশি ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতাত্তোর সময়ের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দল তথা শাসকশ্রেণী এ অবস্থার জন্য দায়ী। লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার এমন অবমাননার ইতিহাস সাম্প্রতিক বিশ্বে প্রায় বিরল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশিত সবকিছু কিছুসংখ্যক তস্কর, লুম্পেন-লুটেরার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। দেশে সরকার আছে বটে, রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কয়েকশ’ ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিবাজ আমলাদের দখলে চলে গেছে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা। এদের হাত দিয়ে গত দুই দশকে দেশ থেকে অন্তত ১০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও রফতানি বাণিজ্যের নামে দেশের শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দেশের জন্য যে সমৃদ্ধি নিশ্চিত হওয়ার কথা তা বেশিরভাগ মানুষের কোনো কাজে আসছে না। উপরন্তু দেশের সব নদনদী, খালবিল, পাহাড় ও বনভূমির উপর নিজেদের দখলবাজি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পানি, মাটি, বায়ু ও পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোদ-বৃষ্টিতে জীর্ণ-শীর্ণ কৃষকের নিরলস শ্রম, প্রবাসী শ্রমিক এবং স্বল্প মজুরির গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঘামে দেশের অর্থনীতির সূচক এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল স্তরে পৌঁছে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক গলাবাজি করলেও দেশের রেমিটেন্স ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাল-মসলায় স্ফীত হচ্ছে কিছু সংখ্যক ধনী ও তাদের ধামাধরা স্বজনেরা। দেশের গরিব মানুষ আরো গরিব হয়ে চরম বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। যেনতেন প্রকারে শিল্পায়ন, রফতানি প্রবৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে দেশের প্রাণপ্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থনীতির রাইজিং টাইগার, উন্নয়নের বিস্ময়কর রোল মডেল ইত্যাদি মুখরোচক লেবেল এঁেট প্রকারান্তরে দেশের আশু সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আর্ন্তজাতিক গণতন্ত্রের র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ একটি ক্রমাবনতিশীল হাইব্রিড রিজিম। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করছে। গত একযুগ ধরে দেশে গুম-খুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারহীন হত্যাকাÐ এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের দায়ে এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষ ও চৌকষ নেতৃত্বের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে এসেছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যেসব অভিযোগ তুলে আমাদের সরকার ও প্রশাসনের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা চাপ সৃষ্টি করছে, এর পেছনে তাদের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতেই পারে। এ ধরণের এজেন্ডা তখনই সফল হতে পারে, যখন অভিযুক্ত রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বহুলাংশে তাদের উপর নির্ভরশীল। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশের শিল্পবাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতিতে পরিনত হওয়ার প্রধান খাত গার্মেন্ট রফতানি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দেয়ার মাধ্যমে বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আয়ের স্বার্থ অনেকটাই পশ্চিমা দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার উপর নির্ভর করে। এভাবেই একেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র পশ্চিমা কর্পোরেট স্বার্থের বলি হয়ে বানানা রিপাবলিকে পরিনত হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর মার্সেনারি বাহিনীর সাথে নবাবের সেনাপতি মিরজাফরের আঁতাত এবং বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘুরে ফিরে একই রকম স্বার্থদ্ব›দ্ব ও কৌশলগত যুদ্ধ, বৈরিতা ও গোপন আঁতাতের রাজনৈতিক নাটক সক্রিয় রয়েছে। বাসস্ট্যান্ডে-সদরঘাটে যাত্রী নিয়ে পরিবহনের কর্মীরা যেমন টানাহেঁচড়ড়া করে থাকে, একইভাবে আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গন্তব্য নিয়েও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পরস্পর প্রতিযোগিতা ও টানাঁেচড়ায় লিপ্ত হয়ে থাকে। ১৭৫৭ সালের যুদ্ধের সময় ফরাসিরা যেমন নবাবের বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। একইভাবে এখনকার যুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে চীন ও পশ্চিমা শক্তিকে মুখোমুখি দেখা যেতে পারে। তবে সভ্যতার দ্ব›েদ্ব বৃহত্তর স্বার্থে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও বোঝাপড়ায় তেমন কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। ঔপনিবেশিক স্বার্থদ্ব›েদ্ব ইঙ্গ-ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ ও বিতন্ডা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের উপর ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক ভাগবাটোয়ারায় বিংশ শতকের শুরুতে সাইক্স-পাইকটের চুক্তিতে উপনীত হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয়দের বহুজাতিক বিনিয়োগের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের মধ্যেও একটি চমৎকার বোঝাপড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের রক্ত, মৌলিক মানবাধিকার, নারীর সম্ভ্রম ও শিশুদের অধিকারের প্রশ্নগুলোকে অগ্রাহ্য করে বেনিয়া স্বার্থে অনৈতিক বোঝাপড়া চলমান বিশ্বব্যবস্থাকে অকার্যকর ও অনাস্থার নিগড়ে নিক্ষেপ করেছে। পুঁজির এই অনৈতিক প্রতিযোগিতা সভ্যতাকে ক্রমাগত কলুষিত, কলঙ্কিত ও দুর্বল করে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বসভ্যতা একটি অবিচ্ছেদ্য দেহের মত। মানবদেহ ও আত্মা যেমন একটি পরিপূর্ণ সত্তা, এর একটি অঙ্গকে দুর্বল করে অন্য অংশ কখনো শক্তিশালী বা সুস্থ্য থাকতে পারে না। একইভাবে অনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অর্থবিত্ত পুঞ্জিভূত করে রাষ্ট্রের কিছু নাগরিক বিলাসব্যসনে ডুবে থাকতে পারলেও এভাবে রাষ্ট্র তার আত্মা ও সত্তাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকা র্ফাস্ট শ্লোগান তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্য জাগিয়ে তুলেছিলেন, লাখ লাখ অভিবাসির ভিসা বাতিলসহ নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ, আইনগত বৈষম্য ও ভেদাভেদ কায়েম করার পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সম্মিলিত উদ্যোগ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, তখন মার্কিনীরা কিছুটা অপাঙ্গতেয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। কারণ, বিশ্বসভ্যতায় কোনো শক্তি যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি কেউ অপরিহার্যও নয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে শুরু করে ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তির মত গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার পরও কোনোকিছুই থেমে থাকে নি। এসবের কিছুই মার্কিনীদের অনুকূলে যায়নি। ট্রাম্পের নির্বাচনী বিপর্যয়ের আগে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘হাউ অ্যা সুপারপাওয়ার সেল্ফ ডেস্ট্রাক্টস’। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইন্ডিয়ায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের কার্যক্রমের মধ্যে এক নিবিড় যোগসাজশ ও সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। এই দুই সরকারের নেপথ্যে জায়নবাদি ইসরাইলীদের কুপ্রভাব ও নিবিড় সখ্যের যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না। টাফ্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ড্রেজনার একের পর এক উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলে গৃহিত ট্রাম্পের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অভিবাসন নীতি কিভাবে তার দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নির্বাচনে মার্কিন জনগণ ট্রাম্পকে লালকার্ড না দেখালে মার্কিন পরবর্তি চার বছরে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো তা সহজেই অনুমেয়। ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতিতে খুব বেশি পরির্বতন ঘটে না। প্রেসিডেন্ট বুশের সূচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র ধারাবাহিকতা প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন বা বারাক ওবামার সময় থেমে থাকেনি। ইরাক ও আফগানিস্তানে লজ্জাজনক সামরিক-রাজনৈতিক পরাজয় কেউ এড়াতে পারেনি। এসব যুদ্ধ মার্কিন স্বার্থের অনুকুল ছিল না। মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জায়নবাদিদের প্রভাবিত ইন্টিলিজেন্স ও মিডিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মার্কিন সাধারণ জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা খর্ব করে ৫-৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ওয়ারবাজেটের প্রফিটে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স’র মধ্যস্বত্বভোগিদের ব্যাংক ব্যালেন্স স্ফীত হয়েছে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের গ্রেট ডিপ্রেশন বা অর্থনৈতিক মহামন্দার চেয়েও কঠিন সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে মার্কিন সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে উঠার দুই বছর আগে ২০১৪ সালে ইউনাইটেড স্টেটস স্টাডি সেন্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ড. রিচার্ড এন হ্যাস এর লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘সুপারপাওয়ার্স প্যাথ টু সেল্ফ ডেস্ট্রাকশন’। তিনি মার্কিন ফরেন রিলেশন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তার লেখায় যেসব প্রবণতা ও সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছিল, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে বসে সেসব বিপদকেই আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছিলেন। রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আত্মঘাতী প্রবণতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও সর্বত্রই আক্রান্ত হচ্ছে মূলত করদাতা সাধারণ মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মঘাতী প্রবণতা ও বিপর্যয় সম্পর্কে রিচার্ড এন হ্যাস যে উপসর্গের কথা বলেছেন, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররাও প্রায় একই ধরণের কথা বলেছিলেন। জনগণের রক্তচোষা উচ্চসুদি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভবিষ্যত সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুইশ’ বছর আগে টমাস জেফারসন বলেছিলেন, ’আই বিলিভ দ্যাট ব্যাংকিং ইনস্টিটিউশনস আর মোর ডেঞ্জারাস টু আওয়ার লিবার্টিজ দ্যান স্ট্যান্ডিং আর্মিজ’। প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর চেয়ে এই ব্যাংকিং ব্যাবস্থাকেই নাগরিকের স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস জেফারসন। রাষ্ট্র ও সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংকিং সিস্টেমে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ দেশের মানুষের হাত থেকে কিছু সংখ্যক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছে বহু আগেই। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মিডিয়া ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে যথেচ্ছ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। এ কারণেই বিদেশের মাটিতে বিশ বছর যুদ্ধ করে ৫-৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে, হাজার হাজার সৈনিকের জীবন বিসর্জন দিয়ে শোচনীয় পরাজয় নিয়ে দেশে ফেরার পর প্রশ্ন উঠেছে, সে সব যুদ্ধের আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা! এমআইসি’র প্রফিটিয়ারিং এজেন্ডা ছাড়া মার্কিনীদের আগ্রাসী যুদ্ধগুলো থেকে কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাফল্য নেই।

সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যখন ভুল অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতির কারণে ডুবে যাচ্ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে, তখন আমাদের মত দরিদ্র ও ভঙ্গুর সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির দেশগুলো ভিন্ন রকমের সামাজিক-রাজনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হয়ে প্রত্যাশিত সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এখানেও রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের আত্মঘাতী প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কানাডিয়ান সমাজচিন্তক হার্ভে লোথিয়ানের সেই উক্তিকে আবারো স্মরণ করতে চাই। করোনাকালে ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারী ৮৩ বছর বয়েসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ‘হাউ অ্যা নেশন সেল্ফ ডেস্ট্রাক্টস’ শীর্ষক ছোট একটি নিবন্ধের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ন্যাশনস আর মেড আপ অব পিপল। ন্যাশনস আর অনলি অ্যাজ স্ট্রং অ্যাজ দ্য বন্ডস বিটুইন দ্য পিপল। স্ট্রং সোশ্যাল বন্ডস স্ট্রং ন্যাশন ;উইক সোশ্যাল বন্ডস উইক ন্যাশন।’ মানুষের মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ছাড়া কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র ও জাতি গঠিত হতে পারে না। আপাত দৃষ্টিতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পন্ন রাষ্ট্র কিভাবে নেতাদের ভুল নীতি এবং উন্নয়নের নামে ঋণের জালে জড়িয়ে দেশকে দেউলিয়া ও ভঙ্গুর করে তোলে তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। আমাদের আজকের আঞ্চলিক, বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীন সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সর্বব্যাপী প্রশাসনিক, আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি দেশকে বড় ধরণের সংকটের দিকে ঠেলে দিতে শুরু করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য-অপাঙ্গতেয় করে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির লালন আমাদের পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অর্ন্তঘাত ও আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকার এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা ও দুর্নীতি ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ছাড়া এ থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।

bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৭ জানুয়ারি, ২০২২, ১:২৪ পিএম says : 0
যখন জালেমরা ক্ষমতায় যায় তখন দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের কে অপমান অপদস্ত করে> সব জায়গায় তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে>দেশে আল্লাহর আইন এর পরিবর্তে মানব রচিত আইন রচনা করে[ এটা হচ্ছে শিরিক আকবর এতে মানুষ কাফের হয়ে ] সারা দেশজুড়ে দুর্নীতির আখড়া বানায় দেশময় দুর্নীতির [যেমন বাংলাদেশ] Surah: Al-Hajj: Ayat:41 “তারা(১) এমন লোক যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত কায়েম করবে(২), যাকাত দেবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর সব কাজের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর ইখতিয়ারে।” সংক্ষিপ্ত তাফসীর: >>> আলোচ্য আয়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। যার বাস্তবায়ন খেলাফতে রাশেদা ও প্রথম শতাব্দীর ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তাঁরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত উদ্দেশ্য সাধন করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর যার কারণে তাঁদের রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বিস্তার লাভ করেছিল, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল এবং মুসলিমরা মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে সফল রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য বড় হৈচৈ ও হাঙ্গামা শোনা যায় এবং প্রত্যেক ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়করা সফল রাষ্ট্রের দাবিও করে থাকেন। কিন্তু প্রত্যেক ইসলামী রাষ্ট্রে অশান্তি, বিশৃংখলা, হত্যা, লুঠতরাজ, দুর্নীতি ও অবনতি ব্যাপক হয়ে আছে এবং অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলেছে। এর একমাত্র কারণ এই যে, তাঁরা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান না মেনে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মহীন) বিধান দ্বারা সাফল্য অর্জন করতে চান। যা আকাশ স্পর্শ করা ও বাতাসকে মুষ্ঠিবদ্ধ করার মত অবাস্তব অপচেষ্টা। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলিতে কুরআনের বর্ণিত নিয়মানুসারে নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদান ব্যবস্থা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধাদানের বিধান বাস্তবায়ন না করা হবে এবং এ লক্ষ্যকে রাজনীতির অন্যান্য কার্যের উপর অগ্রাধিকার না দেওয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সফল রাষ্ট্র কায়েম করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন