শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

ঢাকা দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য নগরীগুলোর মধ্যে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে। এটি হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে নাগরিক নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার বিচার। অন্যদিকে, বাতাসের মানের বিচারে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সেও (একিউআই) বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। একিউআই তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনই বিশ্বের সব প্রান্তের বাতাসের মান নির্ণয় ও প্রকাশ করছে। এ সপ্তাহে (জানুয়ারি ১৯-২২) টানা চারদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে ঢাকা। গতকালও শীর্ষে ছিল। এ সময়ে ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর পিএম ২.৫ এর মাত্রা ছিল ২২৬ থেকে ৩৭২ পিপিএম পর্যন্ত। পিএম ২.৫ পার্টিকেলের মাত্রা ০-১২.০ পর্যন্ত খুবই ভাল মান নির্দেশ করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান অনুযায়ী, ৫০ থেকে ১০০ পিপিএম গ্রহণযোগ্য মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। ১০১ থেকে ১৫০ অস্বাস্থ্যকর এবং তার উপরে ২০০ পিপিএম এবং তার উপরে পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক মাত্রা নির্দেশ করছে। ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ৩২২ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ পার্টিকেলের উপস্থিতি এই শহরের শিশু-বৃদ্ধসহ সব নাগরিকের স্বাস্থ্য ও জীবন বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বাতাসে ভাসমান বিষে শহরের নবজাতকসহ লাখ লাখ মানুষ নিওমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের প্রদাহ ও ক্যান্সারের মত নানাবিধ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হচ্ছে।

করোনা মহামারীতে সারাবিশ্বে মানুষের ইমিউনিটি ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সঠিক পরিচর্যায় করোনা সংক্রমণ থেকে লাখ লাখ মানুষ বেঁেচ গেলেও বায়ুদূষণ ও পরিবেশগত দূষণ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে বাঁচার কোনো সঠিক উপায় নেই। এর একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে, বাতাস ও পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যেসব কঠিন ও দূরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে দেশ-বিদেশের হাসপাতালে যাচ্ছেন, তার বেশিরভাগই বায়ু, পানি, খাদ্যের ভেজাল ও দূষণের কারণে ঘটছে। এক মিনিটও আমরা বাতাসের অক্সিজেন গ্রহণ করা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারিনা। সেই অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে যদি ৩২২ বা তারো বেশি বিপজ্জনক মাত্রার সূ² বিষাক্ত কণা থাকে এবং ফুসফুসে ঢুকে তাহলে জীবনের আয়ু দ্রæতই কমে যায়। ইতোমধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর ৭ মাস। সারা বাংলাদেশে কমেছে ৫ বছর ৪ মাস। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। শুধু আয়ু কমছে না, মানুষ শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলা পরিস্থিতিতে আমরা ধীরে ধীরে একটি অসুস্থ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষকে এমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রেখে, লাখ লাখ মানুষকে রুগ্ন ও হাসপাতালে রেখে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শুধুমাত্র বায়ু ও পানি দূষণের কারণে রাষ্ট্র ও সরকারের সব অর্থনৈতিক অর্জন ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রত্যাশিত সুফল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। গড় আয়ুবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছি। অথচ মানুষের বেঁচে থাকার যে সুস্থ্য পরিবেশ প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। মানুষই যদি সুস্থ্য এবং বেঁচে না থাকে, তাহলে এসব উন্নয়ন দিয়ে কি হবে? কাদের জন্য এ উন্নয়ন? বায়ু, পানিসহ নানাবিধ দূষণের কারণে প্রতি বছর ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দূষণজণিত স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কত সংখ্যক মানুষ প্রতিবছর ডাক্তারের কাছে যায়, হাসপাতালে ভর্তি হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশের লাখ লাখ পরিবার নি:স্ব হয়ে পড়ছে। জটিল এসব রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। শুধু বায়ুদূষণই নয়, শব্দদূষণেও ঢাকা শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। শব্দদূষণে অসংখ্য মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অসংখ্য মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমন ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, জানা নেই। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থপনা, শিল্পদূষণ, মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কারণে প্রতিদিন হাজার টন ধূলিকণা বাতাসে মিশে বায়ুদূষণের মাত্রাকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর নেই। কার্যকর উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বায়ুদূষণসহ অন্যান্য দূষণ যদি সহনীয় পর্যায়ে না রাখা যায়, তবে অচিরেই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বায়ুদূষণ কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কারণে এবং যেসব উৎসের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, সেগুলো রোধ করতে হবে। ঢাকার চারপাশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার ইটভাটা, পরিবেশগত নিরাপত্তাহীন শিল্পকারখানা এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এবং সঠিক বর্জ্যব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু সেমিনার-কর্মশালা করে অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন