শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আত্মহত্যা রুখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

মানুষ যখন জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ হতাশ ও নিরাশ হয়ে পড়ে, বেঁচে থাকা অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করে, তখন অনেক সময় নিজেকে শেষ করে দেয়ার পথ বেছে নেয়। এভাবে স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিনাশ করাকে আত্মহনন বা আত্মহত্যা বলা হয়ে থাকে। আত্মহত্যা সব ধর্ম ও মূল্যবোধে পাপ হিসেবে গণ্য। সব দেশের আইনেও এটা গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। এরপরও মানুষ আত্মহত্যা করে। আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা বিদ্যমান। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আত্মহত্যা এক গভীর মনোরোগের ফল। ক্রোধ, অভিমান, হতাশা, উপায়হীনতা এবং নানামুখী মানসিক চাপ এর প্ররোচক হিসেবে কাজ করে। সব দেশের মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। জাপানে মানুষ ‘দলবেঁধে’ আত্মহত্যা করে বলে শোনা যায়। আমেরিকার মতো সর্বোন্নত দেশে প্রতিদিন গড়ে ১২৩ জন আত্মহত্যা করে। উন্নত জীবন, আর্থিক সঙ্গতি, বিলাস-ব্যাসন ইত্যাদি আত্মহত্যার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, এটা তারই প্রমাণ। আবার অনেক দেশেই দারিদ্র্য আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ। আমাদের দেশেও মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। কোনো কোনো এলাকায় এ হার উদ্বেগজনক। সার্বিকভাবে আত্মহত্যার হার বর্ধমান। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ যেমন আছে, তেমনি শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও আছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কথা নেই। শিক্ষিতরা যেমন আছে, তেমনি অশিক্ষিতরাও আছে। বিস্ময়কর হলেও ইদানিং দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাবে গত বছর সারাদেশে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৬১.৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৪.৩৬ শতাংশ বা ৬৫ জন। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে সম্পর্কগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, মানসিক যন্ত্রণা, পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা এবং আর্থিক সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য এক খবরে প্রকাশ, গত বছর সারাদেশে মোট ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় এটা ৪৪.৩৬ শতাংশ বেশি।

আত্মহত্যা বাড়ছে। আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা বর্ণিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোটেই কম নয়। বিশ্লেষণ বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারীদের ৩৫ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ১৯ বছর এবং ৪৯ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। শিশুকাল থেকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়টায় আত্মহত্যাকারীরা তাদের জীবনের ইতি টেনে দিচ্ছে। আত্মহত্যা যেহেতু মানসিক ব্যাধি, সুতরাং প্রতি বছর হাজার হাজার সম্ভাবনাময় জীবন রক্ষায় মানসিক চিকিৎসার পরিধি ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা বাড়ানো দরকার। আত্মবিশ্বাসহীনতা যেহেতু এর অন্যতম কারণ, কাজেই আত্মবিশ্বাস জাগানিয়া শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে, পারিবারিক ও সমাজিক পর্যায়ে থাকা প্রয়োজন। যেহেতু ধর্মীয় মূল্যবোধ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহস, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার যোগান দেয়, সেহেতু পরিবার, সমাজ ও দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। অসচ্ছলতা ও দারিদ্র্য আত্মহত্যার বিশেষ কারণ হওয়ায় দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির ব্যবস্থা জোরদার করা আবশ্যক। আত্মহত্যার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। আগে কোনো পরিবারের কেউ আত্মহত্যা করলে সেই পরিবারকে ভিন্ন চোখে দেখা হতো। ওই পরিবারে বিয়ে-শাদি করাতে অনেক পরিবার রাজি হতো না। এ ব্যাপারে পরিবার থেকেই এক ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা হতো। এখন পরিবারের সতর্কতা যেমন উঠে গেছে, তেমনি সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কমে গেছে। পরিবার ও সমাজকে ফের সচেতন করা গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা ও আত্মহত্যা কমানো সম্ভব।

ইসলাম আত্মহত্যাকে মহাপাপ এবং আত্মহত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির কথা বলেছে। দুনিয়া পরীক্ষাক্ষেত্র হওয়ায়, ধৈর্যের সঙ্গে সে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। দুঃখ-দুর্দশায় আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য হারানো কারোই উচিৎ নয়। মহান আল্লাহপাকের ওপর ভরসা করে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন: তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালংঘন করে আত্মহত্যা করবে, তাকে আমি অগ্নিতে দগ্ধ করবো, আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। সূরা নিসা: আয়াত ২৯-৩০। সূরা বাকারার অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন: তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করোনা। আয়াত ১৯৫। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এক হাদিসে আছে: এক ব্যক্তি আহত হওয়ার পর অধৈর্য হয়ে আত্মহত্যা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহপাক বলেন: আমার বান্দা আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম। বুখারি ১২৭৫। অন্য এক হাদিসে আত্মহত্যাকারীদের আখেরাতে কীভাবে শাস্তি দেয়া হবে, তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। আত্মহত্যাকারীরা জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকবে। মহান আল্লাহ যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। তিনি ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন, এই ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন: হে মুমিনরা, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। সূরা বাকারা : আয়াত ১৫৩। বলা বাহুল্য, আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর দিকনির্দেশনা মেনে যদি মানুষ চলে এবং আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর প্রদর্শিত সমাজ যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেই সমাজে আত্মহত্যার বালাই থাকতে পারে না। সেই সমাজের কোনো মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না। তাই আমাদের পবিত্র কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, কোরান হাদিসের চর্চা বাড়াতে হবে। এটা এমন এক রক্ষাকবচ, যা আমাদের পরিবার ও সমাজকে আত্মহত্যার গভীর ক্ষত থেকে সহজেই সুরক্ষা দিতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন