বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসলাম ও মানব সভ্যতায় গ্রন্থাগার

মো. ইউসুফ আলী অনিম | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

জ্ঞানসম্ভারের সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রাচীনকাল থেকে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয়। মানবজাতির কৃতিত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে এ গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারকে মানবজাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও জ্ঞান সাধনার সূতিকাগার বলে বিবেচনা করা হয়। মানবসভ্যতার জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য আদিকাল থেকে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয় এবং কালের বিবর্তনে তার বিকাশ সাধিত হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরণের গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানবকল্যাণে বিপুলভাবে গ্রন্থাগার জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়। সভ্যতার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থাগার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মানবকল্যাণে সভ্যতার মূল বাহন হিসেবে কাজ করে আসছে গ্রন্থাগার। সভ্যতার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জ্ঞান সম্প্রসারণে আদিকাল থেকে তথ্য বয়ে নিয়ে আসছে এই গ্রন্থাগার। তথ্যভাণ্ডারের সংরক্ষণ ও ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থেকে মনীষীরা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাসখ্যাত প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার থেকে শুরু করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসহ প্রতিটি গ্রন্থাগারই সভ্যতার বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসলামী সভ্যতায় গ্রন্থাগার ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি অন্যতম মাধ্যম। মুসলিম শাসকগণ জ্ঞানের পরিধি ও ব্যপকতার জন্য বিভিন্ন জনবহুল স্থানে অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিযরতপূর্বক সেখানে মসজিদে নববীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতায় বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে মহানবী সা.-এর নির্দেশক্রমে জ্ঞান চর্চার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই ধারাবাহিকতা থেকেই আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার লাভ করে এবং সেই সাথে গ্রন্থাগারের কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১ - ৭৫০ খ্রি.) দামেস্কে রাজকীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, আব্বাসীয় শাসনামলে (৭৫০-১০৫০ খ্রি.) বাগদাদে বায়তুল হিকমাহসহ আরো অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সময়ের শিক্ষানীতি দেখে পরবর্তী মুসলিম শাসকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সেলজুক শাসক নিজামুল মূলক (১০১৭-১০১৯ খ্রি.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সমসাময়িককালের অন্যতম সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কায়রোতে ফাতেমীয় খলিফারা অসংখ্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা আল আজিজ (৯৭৫-৯৯৬ খ্রি.) এবং তার পুত্র হাকাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার তার উজ্জ্বল নিদর্শন। অপর দিকে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন বিজয়ের পর সেখানেও মুসলিম নৃপতিরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন।

মধ্যযুগের ইসলামী সভ্যতায় গ্রন্থাগারের অপরিসীম দানে সোনালি যুগের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে ইসলামী সভ্যতার পতনের যুগে মুসলিম বিশ্বে গড়ে ওঠা এ বিপুলসংখ্যক লাইব্রেরি নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের কবলে পড়ে। শত্রুরা বর্বরোচিতভাবে এবং পাশবিকতার সাথে এসব জ্ঞান ভাণ্ডারকে ধ্বংস করে দেয়। এ ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বিশ্বমানবতা বঞ্চিত হয়েছে লাইব্রেরিগুলোতে রক্ষিত হাজার বছরের প্রাচীন জ্ঞানসম্ভার হতে। এই মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

গ্রন্থাগার একটি বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠক-গবেষকদের ব্যবহারের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, পাণ্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষিত হয়। গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ খরনৎধৎু-এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ খরনবৎ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক’। খরনবৎ থেকে খরনৎধরঁস শব্দটি এসেছে । যার অর্থ ‘পুস্তক রাখার স্থান’। এ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ শব্দ খরনৎধৎরব অর্থ হলো পুস্তকের সংগ্রহ। জ্ঞানের সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও যুগ পরম্পরায় জ্ঞান সম্ভার পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে গ্রন্থাগারের উদ্ভব। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থাগার হচ্ছে এমন একটি সেবাদানকারী গুণী প্রতিষ্ঠান, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক, অন্যান্য পাঠক ও গবেষকদের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, জার্নাল, থিসিস পেপারসহ অন্যান্য জ্ঞানসামগ্রী কাঠামোগত পদ্ধতিতে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা হয়। গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আলোকিত মানুষ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সহযোগিতা করা।

গ্রন্থাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো। আদিকাল থেকেই মানুষ কোনো না কোনোরূপে লিপিবদ্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে আসছে। প্রাচীনকালে মানুষ লেখার উপকরণ হিসেবে যেসব বস্তু ব্যবহার করত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: মাটিরফলক, পাথর, প্যাপিরাস, কডেক্স, তালপাতা, হাতির দাঁতসহ আরো নানান বস্তু। লিখিত জ্ঞানসম্ভারকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তায় গ্রন্থাগারের উদ্ভব। ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায় গ্রন্থাগারগুলো আধুনিক গ্রন্থাগারের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন রকম ছিল। প্রথম দিকে মানুষ নিজের ঘরের কোনো উপাসনালয়ে ও রাজকীয় ভবনে গ্রন্থ সংরক্ষণ করতে শুরু করে। গ্রন্থাগার ইতিহাসবিদরা এগুলোকে চৎড়ঃড় খরনৎধৎু হিসেবে অভিহিত করেছেন। এগুলো ছিল ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গড়ে তোলা সংগ্রহশালাগুলো সময়ের বিবর্তনে গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। গ্রন্থাগার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্দিরে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালাগুলোই গুরুত্বের বিচারে এগিয়ে ছিল। মিসর, প্যালেস্টাইন, ব্যাবিলন, গ্রিস ও রোমে গ্রন্থাগারের প্রাচীনতম এবং গুরুত্বের দিক থেকে মন্দির গ্রন্থাগার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরই উল্লেখ করতে হয়, সরকারি দলিল-দস্তাবেজের সংগ্রহ বা আর্কাইভসের কথা। গ্রন্থাগারের আদিমতম নিদর্শনগুলোর মধ্যে সরকারি নথির সংগ্রহাগার একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এসব দলিলপত্র লিপিবদ্ধ হতো পোড়ামাটির ফলক, প্যাপিরাস বা পার্চমেন্ট রোল এবং কখনো তাম্র বা ব্রোঞ্জপাত্রে। তবে যে আকারেই সংরক্ষিত হোক না কেন, সরকারি কর্মকাণ্ডের বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে এসব সংগ্রহ। সরকারি দলিল ও মন্দির সংগ্রহের মতোই ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ সৃষ্ট দলিলপত্র ও গ্রন্থাগার উদ্ভবের আদি পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। মিসর, ফিনিশিয়া, ব্যাবিলন এবং পরবর্তীকালে আলেকজান্দ্রিয়া, এথেন্স ও রোমের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে এ ধরনের সংগ্রহ অনেক দেখা যেত। ব্যাবিলনের অধিবাসীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলির পূর্বাভাস বা পূর্বলক্ষণের বিবরণ পারিবারিক সংগ্রহে যোগ করার প্রবণতা ছিল। ধর্মীয় কাহিনী ও ভাষ্য, পুরাণ ও লোককাহিনী এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক নথিপত্র পারিবারিক সংগ্রহে যুক্ত হয়ে এগুলোকে আদর্শ ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করেছিল এবং গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়। ইতিহাসখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি, ব্যাবিলন লাইব্রেরি, আসুরবানিপাল লাইব্রেরি, নালন্দা লাইব্রেরি, পারগামাম লাইব্রেরি, কর্ডোবা লাইব্রেরি ইত্যাদি

লেখক: সহকারী লাইব্রেরিয়ান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক, লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ল্যাব)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন