মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
মানুষ মহান আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এই মানুষকে কেন্দ্র করেই সমগ্র সৃষ্টিজগতের সকল আয়োজন। আধুনিককালে মানুষের জীবন কীভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই মানুষের উন্নয়ন সাধন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন যথার্থ কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়নে কী কী নির্দেশনা দিয়েছে তা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয় আধুনিক উন্নয়ন চিন্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ধারণা। বিশ শতকের শেষ দশকে এ ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে। বর্তমানে উন্নয়ন চিন্তার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যে উন্নয়নের কথাই বলা হোক, সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবসম্পদ। একে ঘিরে এবং এর জন্যই সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টেকসই উন্নয়ন, সমন্বিত উন্নয়ন ধারণা, সামগ্রিক উন্নতি বা সর্বাত্মক সুষম উন্নয়ন, সকল ক্ষেত্রে মানুষের সুখ-সুবিধাই মূল বিবেচ্য হয়ে থাকে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক বা পরিবেশগত কোনো সুবিধা গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমান উন্নয়ন ধারায় প্রথমে তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে আবশ্যিক বলে গণ্য করা হয়। ইসলাম গোড়া থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম মানবকে সত্যিকারার্থে শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে এবং এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থাসমূহ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাস্তব উদ্যোগে গ্রহণ করেছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটির বিকাশ ও বিস্তারে যে পরিমাণ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে এবং গুরুত্ব প্রদানের প্রেক্ষাপটে যে ফল লাভ হচ্ছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। এতে মানুষের বৈষয়িক উন্নয়ন কিছুটা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা বস্তুগত অর্জনের কাছে প্রতিনিয়ত মার খেয়ে যাচ্ছে। মানবিক বিপর্যয়ের চালচিত্র প্রতিদিনই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে, যা মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উন্নয়ন একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যা সমগ্র সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে একটি সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌত কাঠামো, পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ব্যবস্থা ও জীবন ধারণা পদ্ধতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়। উন্নয়ন একটি ব্যাপক ধারণা, যা একটি সমাজকে বর্তমান অবস্থান থেকে অধিকতর কাম্য অবস্থানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে এবং এই কাম্য লক্ষ্যটি নির্ধারিত হয় ঐ সমাজের জনগণের ইতিহাস অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হতে। উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। এটি একটি পথ মাত্র, চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। যে উন্নয়নে মানুষের জীবন উন্নত হয় না বা যাতে মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না, সে উন্নয়ন উন্নয়নই নয়। এ বোধই মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার জনক, যার মূল কথা মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। উন্নয়ন সম্পর্কিত নতুন এ ধারণাটির উদ্ভবের ফলে মানবিক দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে। বৈশ্বিকরণ প্রক্রিয়া জোরেসোরে উচ্চারিত হওয়ার সময়ও স্থিতিশীল ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের সাথে মানব উন্নয়নকে আবশ্যিকভাবে যুক্ত করা হয়। কারণ মানব উন্নয়ন ধারণা সৃষ্টিশীলতা ও বিকাশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। মানব উন্নয়ন ব্যাপক জনগণের পছন্দভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। এটি মানব সক্ষমতার উপর ভিত্তিশীল (জনগণের বিনিযোগের মাধ্যমে) এবং এসব সক্ষমতা সমভাবে ব্যবহৃত হয় (আয় এবং কর্মপ্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অংশগ্রহণমুখী পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন। মানব উন্নয়ন ধারণাটি বহুমাত্রিক ধারণার সমষ্টি। এরমধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক, সর্বোপরি জীবনমান উন্নয়নকে বুঝায়।
১৯৯০ সালে ইউএনডিপির রিপোর্টে বলা হয়, মানব উন্নয়ন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা সমাগ্র সম্পদের সম্প্রসারণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করে। ১৯৯১ সালে মানব উন্নয়নের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নির্দিষ্ট হয়। এগুলো হলোÑ মানুষের উন্নয়ন, মানুষের ধারা উন্নয়ন এবং মানুষের জন্য উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সামাজিক কল্যাণে বিনিয়োগ করা। উন্নয়নের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও প্রয়োগ হলো মানুষের দ্বারা উন্নয়ন আর মানুষের দ্বারা উন্নয়ন হলো প্রতিটি মানুষের চাহিদা, আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ১৯৯২ সালে হিউম্যান ডেভেলাপমেন্ট ইনডেক্স বা মানব উন্নয়ন সূচক নির্ধারিত হয়। সংক্ষেপে একে বলে এইচডিআই, এগুলোর মধ্যে জীবনের দীর্ঘ স্থায়িত্ব, দক্ষতা উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বা সরকারি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে আত্মকর্মসংস্থান অন্যতম। সাধারণ কথায়, মানবসম্পদ উন্নয়নকে বলা হয়, চবড়ঢ়ষব ঈবহঃৎব উবাবষড়ঢ়সবহঃ অর্থাৎ উন্নয়ন ব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ মানবকেন্দ্রিক; মানুষ নিজেরা নিজেদের দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটাবে এবং নিজেরাই তার ফল ভোগ করবে। শিক্ষাবিদ-গবেষকগণের কেউ কেউ মানবসম্পদ উন্নয়নকে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখেছেন যা কর্ম-কৃতিত্ব (ঔড়ন চবৎভড়ৎসধহপব) বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা বলেছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কর্ম-কৃতিত্ব উন্নয়ন বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে সংগঠিত শিক্ষা অভিজ্ঞতা। ইসলামে মানব উন্নয়ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূল বিষয়। কুরআন মাজীদের মৌলিক বিষয় হলো মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মানব উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গঠন। এ উন্নয়নের জন্য ইসলাম মানুষের দৈহিক আকৃতিতে মানুষ হওয়ার সাথে সাথে মানবিক ঔদার্য ও মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি হিসেবে মানুষ সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। আল্লাহতায়ালাই মানুষকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন’। মানুষের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণœ রাখার পথ হিসেবে আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন অনিবার্য করে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন চেষ্টা নৈতিকভাবে সকলের জন্য বিধিবদ্ধ উপায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবশ্যিক হয়েছে জ্ঞান অর্জন, হালাল জীবিকা উপার্জন ও গ্রহণ, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ, আখিরাতে সফলতা- ব্যর্থতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ এবং বিশেষভাবে নৈতিক উন্নয়ন। মুমিন হওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহতায়ালা প্রথম মানুষ আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম (আ.)-এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কুরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নামসমূহ জানাও।’ ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে আদম! তুমি তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’ এরপর যখন আদম তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহতায়ালা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালভাবেই জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ছাড়া সকলেই সিজদা করল। ইবলিস অবাধ্য হল ও অহঙ্কার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (‘আল-কুরআন, ০২ : ৩১-৩৪’) রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন রিসালাত লাভ করলেন তখন তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হল তাও জ্ঞানার্জন বিষয়ক। হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহী লাভ করলেন, পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়–ন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। ‘আল্লাহতায়ালা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষেরা! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়। আল্লাহতায়ালার ইবাদত যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি জিকির করবে, এতে তোমরা সফল হবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদাত করো। ‘আল-কুরআন, (০২ : ১৭২’।) আল্লাহর রাসূল (সা.) এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোটা রক্তের জন্যে নরকই যথোপযুক্ত আবাস। ইসলামে কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকাকে সমর্থন করা হয়নি। ব্যক্তি নিজে উপার্জন করবে, নিজের আয়ের উপর নির্ভর করবে। অন্য কারো আয়ে ভাগ বসাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন, পবিত্রতম উপার্জন হলো মানুষের নিজের হাতের পরিশ্রম এবং প্রত্যেক বিশুদ্ধ ব্যবসায় (এর উপার্জন)। শ্রমিককে যেন তার প্রাপ্য মজুরির জন্য নিয়োগকর্তার পেছনে ঘুরতে না হয় এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য নিয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহতায়ালার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তি সত্তার উন্নতি বিধান করে। সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদিসে মানুষের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর, তবে তোমার দুনিয়ার অংশ ভুলে যেয়ো না। কিয়ামাতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম যার বিচার হবে সে হবে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা সম্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে- আমি তোমার পথে যুদ্ধ করেছি; এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে যুদ্ধ করেছো যেনো তোমাকে বীরপুরুষ বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। দ্বিতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন আলিম। সে নিজে শিক্ষা লাভ করেছে, অপরকে তা শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময় কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, দুনিয়াতে আমি শিক্ষা লাভ করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে জ্ঞান অর্জন করেছিলে যেনো তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। কুরআন মাজীদ এ জন্যে তিলাওয়াত করেছ যেনো তোমাকে কারী বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। তৃতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। আল্লাহ তাকে সচ্ছল করেছেন এবং বিপুল সম্পদ দিয়েছেন। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, যে পথে খরচ করলে তুমি খুশি হও, সে জাতীয় সব পথেই তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনÑ তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমিতো এগুলো এ জন্যে করেছো যেনো তোমাকে দানবীর বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুর করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। ইসলাম যে বিষয়গুলোকে চরিত্রের সুন্দর দিক এবং অবশ্য অর্জনীয় গুণ হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলোকে আত্মার গুণ হিসেবে আত্মস্থ করা, নৈতিক বৈশিষ্ট্য পরিণত করা এবং জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে স্বভাবতই মানুষ সম্পদে পরিণত হবে। যে সম্পদ দুনিয়ায় ব্যক্তির নিজের এবং অপরাপর সকলের কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করবে। কুরআন হচ্ছে মুমিনের গাইড লাইন, জীবন বিধান। এরমধ্যে আল্লাহতায়ালা মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। সুন্দর চরিত্র গড়ে তোলার জন্য সবার আগে তাই কুরআন অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি যদি দাবি আদায় করে আল-কুরআন তিলাওয়াত করেন, তাহলে কুরআনই তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর কুরআন মাজীদের শিক্ষা ব্যক্তির আত্মিক-আচরণিক ও বৈষয়িক উন্নতিতে সন্দেহাতীতভাবে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। আল-কুরআনের ব্যাখা হলো হাদিস। কুরআন মাজীদে আল্লাহতায়ালা যে কোনো হুকুমের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) সে মূলনীতি বাস্তবায়নের পথনির্দেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে থেকে কোনো কথা বা তত্ত্ব হাদিসের মাধ্যমে পেশ করেননি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন। আর তিনি (মুহাম্মাদ সা.) নিজে প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তাঁর নিকট প্রেরিত ওহী ছাড়া এগুলো আর কিছু নয়। অন্যত্র সকল মানুষকে আল্লাহতায়ালা আদেশ দিয়েছেন। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন (অর্থাৎ যা করতে নির্দেশ দেন) তা গ্রহণ করো আর যা থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো। সত্য কথা বলা সুন্দর চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। সত্যবাদী হওয়া ছাড়া মুমিন হওয়া যায় না। ইসলাম সত্য, বাকি সবকিছু মিথ্যা। এখন কেউ যদি সত্যকে ধারণ করে সে ধারণ করবে ইসলামকে। আর কেউ যদি মিথ্যা বলার অভ্যাস করে, সে অবশ্যই ইসলাম বর্জনকারী হবে। ত্য মানুষকে সততার পথে পরিচালিত করে, আর মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে। সবর বা ধৈর্য ধারণ করা সুন্দর চরিত্রের একটি অনিবার্য দিক। ধৈর্যধারণ ছাড়া সুন্দর চরিত্র সার্থক ও অর্থবহ হয় না। সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে হলে তাই ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। কুরআন মাজীদে এসেছে, আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন ধৈর্যশীলদের। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। ধৈর্যশীল মানুষ নিঃসন্দেহে অনন্য গুণের অধিকারী। মানবকে সম্পদে পরিণত করার অন্যতম মৌলিক এ গুণটি অর্জন করা ইসলাম মুমিনের জন্য আবশ্যিক করেছে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালার এ নিয়ামতসমূহের বিনিময়ে তাঁর আদেশ পালন করা হলো কৃতজ্ঞা জানানো। আল্লাহতায়ালার আদেশ মেনে চললে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে পারবে না। ফলে তার চরিত্র সুন্দর হবে। আল্লাহ তাঁর নিয়ামত আরো অধিকাহারে শোকরকারীকে দান করবেন। যেমন তিনি বলেছেন, যদি তোমরা শোকর করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের নিয়ামত বাড়িয়ে দেবো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন