কয়েক দশকের মধ্যে নজিরবিহীন এক কঠিন পরিস্থিতির মাঝে বেইজিংয়ে শুরু হয়েছে শীতকালীন অলিম্পিক গেমস। একদিকে, কোভিড-১৯ নিয়ে চীনে কঠোর বিধিনিষেধের বেড়াজাল, অন্যদিকে চীনে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলে পশ্চিমা কিছু দেশের গেমস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এত কিছুর মধ্যেও বেইজিংই একমাত্র শহর যেটি গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন দুই অলিম্পিকেরই স্বাগতিক শহর হবার মর্যাদা পেলো। গতকাল প্রায় দর্শকশূন্য বেইজিং জাতীয় স্টেডিয়ামে জাঁকালো এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু হলো এবারের শীতকালীন অলিম্পিকসের। তার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্রীড়াযজ্ঞের উদ্বোধন ঘোষণা করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। স্বশরীরে এসময় স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমারন খানের মতো বিশ^নেতারাও। পরে পাকিস্তানের ১৯৯২ বিশ^কাপ জয়ের নায়ক অলিম্পিক ভিলেজ ঘুরে দেখবেন বলে জানিয়েছেন দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী।
১৭ দিনের এই ক্রীড়াযজ্ঞ চলবে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার ১০৯টি আলাদা ইভেন্টে প্রতিযোগিতা করছেন ১৯ দেশের প্রায় তিন হাজার অ্যাথলেট। এরপরে হবে শীতকালীন প্যারালিম্পিক্স- চৌঠা মার্চ থেকে ১৩ই মার্চ অবধি। যেখানে ৭৮টি ইভেন্টে প্রতিযোগিতা করবেন প্রায় সাড়ে সাতশ’ অ্যাথলেট। যেখানে অলিম্পিক ইভেন্টগুলো হচ্ছে সেখানে বরফের যে ঢাল তার বেশিরভাগটাই মানুষের তৈরি। ভেতরে যে বরফের প্রতিযোগিতার রিংক তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বরফ যাতে না গলে তার জন্য হিমশীতল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে গম্বুজাকৃতি স্টেডিয়ামের একপাশে বসানো বিশাল বিশাল ফ্রিজারের মাধ্যমে।
চীনের সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অলিম্পিকস আয়োজনে খরচ করছে তিনশ নব্বই কোটি ডলার। স্কেটিংসহ কিছু ইভেন্ট হচ্ছে বেইজিংয়ের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে। স্কি ও স্নোবোর্ডিং জাতীয় ইভেন্ট- যেগুলোর জন্য উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন, সেগুলো হবে বেইজিংয়ের কিছুটা বাইরে। এসব জায়গায় যেহেতু তুষারপাত হয় খুবই কম, তাই চীন প্রায় ১২ লক্ষ ঘনমিটার কৃত্রিম তুষার তৈরি করেছে। রাশিয়ার সোচিতে ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজনের সময় সেখানেও কৃত্রিমভাবে তুষার তৈরি করা হয়েছিল। কারণ সোচি রাশিয়ার সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলগুলির একটি।
তবে এই শীতকালীন অলিম্পিক নিয়ে খুব একটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না চীনা নাগরিকদের মধ্যেই। কেননা প্রায় কারোরই সেখানে ঢোকার অনুমতি নেই। চীনে যাতে একজনও কোভিড আক্রান্ত না হয় সেজন্য দেশটি যে ‘জিরো কোভিড’ নীতি নিয়েছে সেই কঠোর নীতি বাস্তবায়নের নতুন উদ্যোগ চলছে এখন দেশটিতে। কাজেই সাধারণ জনগণকে অলিম্পিক দেখার জন্য কোন টিকেট বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একমাত্র ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর কর্মচারীরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে ইভেন্ট দেখতে পারবেন। তারপরেও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ঢোকার জন্য তাদের টেস্টিং এবং কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আর উৎসাহী সাধারণ মানুষকে খেলা দেখতে হবে টিভির পর্দায়।
কোভিডের বিস্তার ঠেকাতে চীন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি অংশ হল মাঠে সাধারণ দর্শকদের ঢুকতে না দেয়া। এছাড়াও ভাইরাস যাতে না ছড়ায় তার জন্য অ্যাথলেট এবং কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে অলিম্পিক এলাকার ভেতরে এবং তাদের থাকতে হচ্ছে নির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া গণ্ডি বা ‘বাবল’ এর মধ্যে। ওই গণ্ডির বাইরে তাদের বেরনো নিষেধ। যাদের একটি বাবল থেকে অন্য আরেকটি বাবল-এ যাবার প্রয়োজন হবে, তাদের সেজন্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে গাড়ি যদি কোন দুর্ঘটনায় পড়ে, যেখানে সাধারণ মানুষ জড়িত, সেখানে তারা যেন কোন অবস্থাতেই সাধারণ মানুষের সামনাসামনি না যান, তারা যেন নিজেদের গাড়ির ভেতরেই থাকেন।
কোভিডের কড়াকড়ি ছাড়াও এই অলিম্পিকের আরেকটি বিতর্কিত দিক হল আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আরও ১২টির মত দেশের উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের এই অলিম্পিক বয়কট। চীনের মানবাধিকার রেকর্ডের ইস্যু তুলে তারা এই অলিম্পিকে যোগ দেননি। তবে, চীনা নেতারা এবং চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কূটনৈতিক এই বয়কটকে মোটেও আমল দিচ্ছেন না। তারা বলছেন এটা গেমসের ‘রাজনীতিকরণ’।
বেইজিং ২০২২ অলিম্পিকের সরকারি সেøাগান হল, ‘অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য একসাথে পথচলা’। বাসস্টপে, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে সর্বত্র এই বাণী লেখা পোস্টার সাঁটা হয়েছে। হাস্যোজ্জ্বল শিশুদের নাচ গানে সমৃদ্ধ প্রচারণা ভিডিও ছাড়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে। শি জিনপিং-এর সরকার গত মাসে শিনজিয়াংয়ে এই ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার অভিযোগ চীন অস্বীকার করে আসছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন