বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য

| প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীতে যে-কোনো অবকাঠামো নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (রাজউক) পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। গত রোববার আসন্ন বর্ষায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পানিবদ্ধতা নিরসনে গ্রহণ করা কার্যক্রমের পর্যালোচনা সভায় তিনি আরো বলেছেন, শুধু অনুমোদন দিলেই হবে না, সিটি করপোরেশনকে অনুমোদন করা অবকাঠামো নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থাও রাখতে হবে। মন্ত্রীর এই বক্তব্য বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তাদের অভিমত: রাজধানীর যে-কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন এবং অনুমোদিত অবকাঠামো নিয়মিত তদারকি রাজউক করে থাকে। এটা রাজউকেরই দায়িত্ব। রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে একই কাজ দেয়া অপ্রয়োজনীয়। এটা সময়ের অপচয় এবং এতে হয়রানি ও ঘুষ-দুর্নীতির সমূহ আশংকা বিদ্যমান রয়েছে। একই ধরনের অনুমোদন দুই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেয়ার কোনো মানে নেই। যে কাজ রাজউকের, তা যদি সিটি করপোরেশনও করে, তবে রাজউকের দরকার কী? ‘এক ঘর যে দো পীর’ হতে পারে না। হলে বিবাদ হবে, নাগরিকদের বাড়তি ঝামেলা ও ভোগান্তিতে পড়তে হবে। যদি এমন হয়, রাজউক যে অবকাঠামোর অনুমোদন দিয়েছে, সিটি করপোরেশন সে অনুমোদন মানলো না বা অনুমোদন দিলো না, তাহলে কী হবে? অথবা যদি এমন হয়, দুই কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোনো অবকাঠামো তদারকির ক্ষেত্রে দুই কর্তৃপক্ষের ভিন্নমত হলো, তাহলেই বা কী হবে?

ইতোমধ্যে মন্ত্রীর প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্যের সমালোচনা আসতে শুরু করেছে। নগর পরিকল্পক স্থপতি ইকবাল হাবিব পত্রিকান্তরে একে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে সরকার যখন অনুমোদনের বিষয়টি ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করছে, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত তার খেলাপের নামান্তর। তার মতে, মানুষ বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে শত শত কোটি টাকা ঘুষ দেয়। এমন সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই জন ও ব্যবসায়ী বান্ধব হতে পারে না। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান একে নগরবাসীর জন্য আরেকটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধবতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁরও মত, এতে মানুষ হয়রানির শিকার হবে। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুর রশীদ বাবুর মতে, এখন একজন রিয়েলটরকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে রাজউক, সিভিল এভিয়েশন ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। আর শিল্পকারখানার জন্য নিতে হয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা ছাড়পত্র। আগে ওয়াসা, ইলেক্ট্রিসিটি, বিটিআরসি, তিতাসের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হতো। এখন অবশ্য সেসব নিতে হয় না। বলা বাহুল্য, রাজধানীতে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই যে অনুমোদন নিতে হয়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অপরিসীম শ্রম ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এইসঙ্গে অকাতরে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া জমি-জমা, বাড়িঘর ও শিল্প-বাণিজ্যিক স্থাপনার কোনো কাজই হয় না। কথিত আছে, রাজউকের ইট-কাঠ পর্যন্ত ঘুষ খায়। অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা কমবেশি প্রযোজ্য। অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন ও তার নিয়মিত তদারকি রাজউকের দায়িত্ব হলেও সে দায়িত্ব ঠিকমত পালিত হয় না। হলে ভুল নকশার অবকাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ ও নিম্নমানের স্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের অবস্থিতি, আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা ইত্যাদি কীভাবে টিকে থাকতে পারে? রাজউক তার দায়িত্ব পালন করছে না, সেখানে ঘুষ-দুর্নীতির গড়ে উঠেছে, তার কাছ থেকে সেবা প্রত্যাশীরা বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে- এসবই সত্য, তাই বলে কি তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সিটি করপোরেশনের হাতে তুলে দিতে হবে? এর বদলে রাজউককে দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অনিয়ম-দুর্নীতি মুক্ত করলেই তো হয়।
সিটি করপোরেশন আহামরি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নয় যে, রাজধানীর অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন ও তা তদারকির দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করা যায়। সিটি করপোরেশন নিজের কাজই যথাযথভাবে করতে পারে না। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার চেহারা দেখলেই সেটা বুঝা যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই চিত্র দৃশ্যমান। মশা পর্যন্ত দমন করতে পারে না সিটি করপোরেশন। তারই হাতে রাজউকের একটি বড় দায়িত্ব দেয়ার কথা হচ্ছে। এ দায়িত্ব পালনে সিটি করপোরেশন যে সফল হবে না, সেটা এখনই বলে দেয়া যায়। অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষের জন্য সিটি করপোরেশনের বিখ্যাতি কম নয়। রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন এবং মশা দমন কার্যক্রমসহ তার প্রায় সব কাজের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সিটি করপোরেশনে গিয়ে বিনা ঘুষে কেউ কোনো সেবা পেয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। সেই সিটি করপোরেশনের হাতে রাজধানীর অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্ব প্রদান কোনোভাবে সমীচীন হবে না। গণহয়রানি ও অর্থ নাশের বরং আর একটি নতুন অ্যাভেনিউই খুলবে এতে। এমতাবস্থায়, এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকাই হবে অধিকতর শ্রেয় ও কল্যাণকর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন