শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

ইমাম মুয়াজ্জিন খাদেম : সম্মানিত তিনজন

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

ব্রিটিশ শাসন শুধু আমাদের দেশ দখল করেনি, আমাদের সম্পদ লুটে নেয়নি, আমাদের ইমানের দুর্ভেদ্য ঘরেও অনেক আঘাত হেনেছে। ইমানের ঘরে আঘাত হেনে আমাদের এক্কেবারে ইমান হারা করতে পারে নি, আমাদের ইমানের সবটুকু লুটে নিতে পারে নি। কিন্তু ইমানের দুর্ভেদ্য দুর্গে অনেক ফুটো করে দিতে পেরেছে। দীর্ঘ প্রায় ৭৪ বৎসর পূর্বে আমরা তাদের তাড়াতে পারলেও ইমানের দূর্গে তাদের করা ছিদ্রগুলো এখনও মেরামত করার জন্য সচেতন হতে পারি নি। এটা কি আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয় নয়?

আল্লাহ তায়ালার নিকট মসজিদ সবচেয়ে প্রিয় স্থান। যারা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় তারাই মসজিদ আবাদ করেন। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদিম পেশা নয়। এক পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সমাজের নেতৃস্থানীয় সকল মুসলমানের। সমাজের প্রত্যেক মুসলমান হবে, মসজিদের খাদেম। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী হবেন মুয়াজ্জিন। সমাজের নের্তৃস্থানীয় ব্যক্তি হবেন ইমাম। সকল ইমানদারের মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা তাওবার ১৮ আয়াতে বলেন, নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজির আবাদ (রক্ষনাবেক্ষন) করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা হেদায়েত প্রাপ্তদের অর্ন্তভুক্ত হবে।

দুই শত বৎসরের ইংরেজ শাসনে আমি অর্থ বিত্তে, চিন্তায় জ্ঞানে, ইমানে আমলে এক পঙ্গু জাতিতে পরিনত হয়েছি। দিন দিন এ পঙ্গুত্ব আরো বাড়ছে। গোলামীর জিঞ্জির থেকে আমরা বের হতে পারলেও যারা আমাদের নের্তৃত্বে আছেন, তারা গোলামী আমলের যে ট্যাবলেট গলদকরণ করেছেন। তা যেন আর হজম হচ্ছে না। পেটে জমে আছে। অর্থ বিত্তে একটু পরিবর্তন এলেও চিন্তার বৈকল্য কোন ভাবে কেটে উঠতে পারছি না।

সমাজে ইমাম, মুয়াজ্জিন, মসজিদের খাদেম যেন সবচেয়ে নিম্ন স্তরের। সমাজের সকলের কাজ তারা নিজেরা আঞ্জাম দিচ্ছেন। সকলের পক্ষ থেকে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। সকলের দায়িত্ব ছিল তাদের সম্মান মর্যাদা নিয়ে ভাবা। যারা আমার পক্ষ থেকে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। আমার পেরেশানী, আমার ব্যস্ততা, আমার জবাব দিহিতার দায় থেকে আমাকে মুক্তি দিচ্ছেন। তারা কিভাবে আমার কাছে অবহেলার পাত্র হতে পারেন! বড় আফসোসের বিষয়! আসলে আমি চিন্তার ভারসাম্যহীন, অবুঝ, নাদান, মুর্খ, না অন্য কেউ। আমি মুসলিম বলে দাবী করলে অবশ্যই আমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে।

ইসলামী সমাজে সবকিছু হবে মুসলিম সরকার কর্তৃক পরিচালিত। এলাকার সরকারী বড় আমলাই হবেন সমাজে মসজিদের ইমাম। যোগ্য ব্যক্তিকে সরকার মুয়াজ্জিন হিসাবে নিয়োগ দিবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদেম সরকার নিয়োগ প্রদান করবে। মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, খাদেম মানুষের দয়ার পাত্র নয়। বরং হবেন সরকারী কর্মকর্তা। আগে এটাই ছিল মুসলিম সমাজের রীতি, পদ্ধতি। ব্রিটিশের সময় আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। আজো সেই রীতি পদ্ধতি পুনরুদ্ধার হয় নি।

মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন যতটুকুই থাকুক। দেখুন খাদেমের অবস্থা? শহর কেন্দ্রিক বড় মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম তিন পদেই লোক আছে। কোন কোন মসজিদে খাদেম নেই। মুয়াজ্জিনই খাদেমের কাজে আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। গ্রামের বেশির ভাগ মসজিদে মুয়াজ্জিন, খাদেম নেই। ইমাম সাহেবই ইমামতির পাশাপাশি মুয়াজ্জিন ও খাদেমের কাজে আঞ্জাম দিয়ে যান।

আসুন একটু ভেবে দেখি, যিনি মসজিদের খাদেমের কাজ করেন, তার কাজ কি? তার কাজ মসজিদ পরিস্কার রাখা, মসজিদের বিছানা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, অযুখানা, বাথরুম পরিস্কার রাখা ইত্যাদি। যারা মসজিদে আসেন তারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর সামনে মাথা পেতে দিতে আসেন। তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এই প্রিয় বান্দাদের মাথা পেতে দেওয়ার কাজ সুন্দর ভাবে করার জন্য খাদেম সাহেব নিরলস ভাবে কাজ করে যান। আমার আপনার শত হাজার আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের সেজদার জায়গা, যেখানে মহান রবের পায়ে নিজেকে সপে দেন, লুটিয়ে পড়েন এই পবিত্র আর দুনিয়ার সবচেয়ে দামী জায়গা, সবচেয়ে দামী কাজ করার জন্য তিনি ঝাড়ু দিয়ে, ধুয়ে- মুছে পরিস্কার রাখেন। আমি আপনি আরো শত মুসলিম ঐখানে সেজদায় লুটিয়ে পড়ি। একটু চিন্তা করে দেখুন এই খাদেম সাহেব কত কত দামী কাজ করে যাচ্ছেন। তাকে আমার কত সম্মান করা উচিত। খাদেম সাহেব কত দামী আর সম্মানী। তিনি আল্লাহর কত প্রিয়। তার অন্তর সব সময় মসজিদে লেগে থাকে। মহা বিচারের দিন যার স্থান আরশের ছায়ায়।

দি¦তীয়ত মুয়াজ্জিন সাহেব, আমাকে আপনাকে প্রতিদিন পাঁচ বার আমার দায়িত্ব স্মরণ করে দেন। মাওলার দেয়া, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো তরিকায় হৃদয়ের সম্পূর্ণ আবেগ, ভালবাসা আর দরদ দিয়ে সুললিত কন্ঠে আমাকে মাওলার সামনে জামাতের সাথে মাথা পেতে দেওয়ার আহবান জানাচ্ছেন। আমি কাজের ব্যস্ততায় আমার উপর অবধারিত কাজ ভুলে যাই। তিনি ভুলে যান না। আমার দায়িত্ব পালন সহজ ও নিবিড় করে দেওয়ার জন্য পাঁচ বার আমাকে ডেকে দিচ্ছেন। আমি শেষ রাতে আরামের ঘুমে ডুবে থাকি। মুয়াজ্জিন সাহেব মধুর কন্ঠে আমাজে বলছেন, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম। আমি দিনের এক্কেবারে মাঝখানে খুব কাজে ব্যস্ত। কাজ ছাড়া কোন কিছুর খেয়াল নেই। মুয়াজ্জিন সাহেব আমাকে ডেকে দিচ্ছেন। ভাই এখন মাওলার নিকট হাজিরা দেওয়ার সময়। কাজ বন্ধ রেখে মসজিদে এসে একটু হাজিরা দিয়ে যান। জামাতের সময় আপনার নাম ডাকা হবে। এখানে অনুপস্থিত থাকা আপনার জন্য খুবই মারাত্মক। নামাজে আসুন। এসে রহমতের সঞ্জিবনী সুধা পান করে নিজেকে একট জ্বালাই করে নেন। নামাজে এসে কল্যাণ নিয়ে ঘরে ফিরেন কিংবা কাজে যান। আমি যখন আছরের সময় একটু ব্যস্ততা, একটু খেল তামাশায় লিপ্ত মুয়াজ্জিন সাহেব আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, এত রঙ তামাশায় বিভোর হয়ে যাবেন না। আসুন আবারো একটু সময় মাওলার সামনে হাজিরা দিয়ে যান। আপনার ডাক পড়েছে। জোহর থেকে ইশা পর্যন্ত মুয়াজ্জিন সাহেব ঘন ঘন আমাকে স্মরণ করেন। কারণ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আমোদ প্রমোদে মানুষ লিপ্ত হয়। কিন্তু আমার সম্মানিত মুয়াজ্জিন এসবে যান না। আমাকে শুধু মাওলার দিকে ডাকেন।

আমার প্রিয় ইমাম সাহেব, যিনি আমার মাওলার সামনে আমার লুটিয়ে পড়ায়, মাওলার পায়ে সেজদা করায় আমার নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে আমরা জামাতের সাথে নিয়ম মেনে তাকে অন্সুরন করে মাথা পেতে দেই। তার তাকবীরে তাহরিমার সাথে হাত উঠাই তার ফাতেহার শেষে আমিন বলি, তার রুকুতে রুকু যাই তার সাথে সেজদা করি। তাকে আগবাড়িয়ে আমি কোন কিছুই করি না, করতে পারি না। তিনি সালাম ফিরালেই তার সাথে সালাম ফিরিয়ে আমি নামাজ শেষ করি। আমার ইমাম, আমার নেতা, আমার সেনাপতি। কি করে তাকে অবহেলা করি। নামাজের বাইরে যদি তাকে সম্মান না করি, নামাজের ভিতরে তার নেতৃত্বে কি করে আমার এতমিনান আসবে, আমার খুশু খুজু আসবে। যে মসজিদে মুয়াজ্জিন নেই, খাদেম নেই সেখানে আমার সম্মানিত ইমাম সাহেবই অন্য সম্মানজনক দুটো কাজও করছেন। তাহলে তার হক আমি কি দিয়ে আদায় করতে পারি। আমার সাধ্য কি আছে তার হক আদায় করার। আমি কি তাকে উপযুক্ত সম্মান আর সম্মানী দিতে পারব। কোন ধনী, কোন মহাজন, কোন দানবীর কি আমার সম্মানিত ঐ ইমাম সাহেবের হক আদায় করবে সক্ষম হবেন। একটু বলবেন কি কোন ভাই।

আসুন সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মানিত করে নিজেকে পরকালে সম্মানিত করার পথ অবলম্বন করি। নিজের মুক্তি তালাশ করি। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমগনকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অসম্মান করে নামাজে খুশু খুজু আনা কি করে সম্ভব, একটু ভেবে দেখি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Anwar ২৩ মে, ২০২২, ৬:৫৩ এএম says : 0
ভাল।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন