বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

মাটির দালানের ঝুপড়ি ঘরে এখনো ওদের বসবাস

প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এএফএম ফারুক চান মিয়া, ছাতক (সুনামগঞ্জ) থেকে
ছাতক শহরের অতি নিকটবর্তী এলাকায় মাঠির দালানে বসবাস করছে প্রায় দু’হাজারেরও বেশি পরিবার। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার যুগেও যেন ওদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। ওরা যুগ যুগ থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছে নিজেদের হাতে গড়া মাটির দালানের ঝুপড়ি ঘরে। মাটির দালানে বসবাসকে নিজেদের আভিজাত্য মনে করছেন এলাকাবাসী। উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়ন ও ছাতক পৌরসভার ছোট-বড় টিলা-পাহাড়ে বেষ্টিত জনপদ ঘুরে অভাবি মানুষের বসবাসের এ চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরিকালে নোয়ারাই ইউপির জোড়াপানি, কুপিয়া, কৈয়াদল, মহিষমারা, রাজগাঁও, জয়নগর, কুরিয়া, বাঁশটিলা, শাহ আরেফিননগর, মারোয়াটিলা, বড়গললা, রংপুর, গোদাবাড়ি, মানিকপুর, কচুদাইড়, ছাতক পৌরসভার নোয়ারাই ও নোয়ারাই-ইসলামপুর গ্রামের লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্যে ছোট্ট ঝুপড়ির মতো করে নিজ হাতে তৈরি করেন মাটির দালান। এসব দালানে নিজেদের সাধ্যমতো টিন ও ছনের (খড়ের) চাল তৈরি করে তারা যুগ যুগ থেকে বসবাস করে আসছেন। নিজেদের হাতে তৈরি এসব মাটির দালানে বসবাসে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও আত্মতুষ্টির কথা জানিয়ে তারা বলেন, রড-সিমেন্টের তৈরি দালানের চেয়ে তাদের নিজ হাতে মাটি দিয়ে তৈরি দালানের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। দালান ঘরের চেয়ে উন্নত কারুকাজ দিয়ে তৈরি করা হয় এগুলো। আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের মতো আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এগুলোতে ব্যবহার করা হয় দর্শনীয় কারুকাজসহ দরজা-জানালা। সাধারণ একটি মাটির তৈরি দালানের স্থায়িত্ব হচ্ছে একশ’ থেকে দেড়শ’ বছর। এগুলোর সবই ভূমিকম্প সহনীয়। কোনো সময়েই মাটির দালানের দেয়াল ভেঙে অথবা মাটির দালান চাপায় কোনো মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি বলে তারা দাবি করেন। মাটির দালান তৈরি করতে ৩ থেকে ৪ মাস সময় ব্যয় হলেও এটির তৈরি খাতে কোনো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। টিলার চিকনি মাটি দিয়ে নিজেদের বসবাসের জন্যে তৈরি করা হয় এসব মাটির দালান। যা-তাদের সংস্কৃতিতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে সর্বমহলে যুগ যুগ থেকে সমাদৃত হয়ে আসছে বলে জানান। জানা যায়, মাঠির দালানে টিলা থেকে সংগৃহীত চিকনি মাটি ও পানির সংমিশ্রণে এটি তৈরি করা হয়। ঘরের চাল দেয়া হয় ছন ও টিন দিয়ে। আগেকার দিনে এলাকার প্রায় প্রতিটি ঘরেই দেয়া হতো ছনের চাল। এখন অনেকে সাধ্যানুযায়ী চালে টিন ব্যবহার করছেন। এসব মাটির দালানের দেয়ালের পুরুত্ব হচ্ছে এক ফুট থেকে দেড় ফুট পরিমাণে। অনেক দালানের দেয়ালের ভেতরে বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। কাঠ ও বাঁশের তৈরি দরজা ব্যবহার করা হয় এগুলোতে। এসব দালানে প্রয়োজন মতো জানালা তৈরি করায় ঘরের সৌন্দর্য অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘরে বসবাস করলে আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনে হয়। মাটির ঘরে বসবাস স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই উপকারী বলে তারা দাবি করেন। তৈরির সময়ে মাটির নিচ থেকে গাঁথুনি দিয়ে দেয়াল নির্মাণের ফলে ছিঁচকে চোরও সিঁদেল চোরের উপদ্রব থেকে একেবারেই মুক্তি পাওয়া যায়। দেয়ালের পুরুত্ব এক ফুট থেকে দেড় ফুট থাকায় বন্দুকের গুলিও এসব দেয়াল ভেদ করতে পারবে না। টিলার ভেতর থেকে সংগৃহীত চিকনি মাটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে প্রথমে মাটি ভেঙে গুঁড়ো করা হয়। এরপর গুঁড়ো মাঠির সাথে কয়েকদফা পানির সংমিশ্রণ দিয়ে এসব মাটি থেকে আঁঠালো জাতের কাঁদা তৈরি করে দেয়াল নির্মাণের উপযোগী করে তোলা হয়। দালান তৈরি করতে একটি দেয়ালের একহাত পরিমাণে উঁচু গাঁথুনি করার পর ইহা শুকানোর জন্যে আরো ২/৩ দিন সময় অপেক্ষা করতে হয়। দেয়াল শুকানোর পর আবারো নির্মাণ কাজ শুরু করতে হয়। এভাবেই একটি দালান তৈরি করতে তাদের ৩ থেকে ৪ মাস সময় ব্যয় হয়। আর দালানটি বৃষ্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা করা গেলে একশ’ থেকে দেড়শ’ বছর স্থায়িত্ব পায়। জানা গেছে, এসব গ্রামের প্রায় লোকজন হতদরিদ্র ও দিনমজুর থাকায় ছোট ছোট মাটির দালান তৈরি করে পরিবার নিয়ে যুগ যুগ থেকে বসবাস করে আসছেন। টিলা এলাকায় পুকুরের ব্যবস্থা না থাকায় মাত্র একশ’ ফুট গভীরতার মধ্যেই একটি টিউবওয়েল বসানোরও ক্ষমতা নেই অনেকের। এসব এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরেই টিউবওয়েলের সুস্বাদু পানি পাওয়া যায়। জোড়াপানি গ্রামের আব্দুল করিম, আব্দুুল বাতির, রফিক মিয়া, আশ্রব আলী, জামাল মিয়া, সোনামালা বিবিসহ অনেকে জানান, জোড়াপানি গ্রামের প্রতিটি পরিবার মাটির তৈরি দালানে বসবাস করলেও এখন অনেকেই সাধ্যানুযায়ী রড-সিমেন্টের পাকা দালান তৈরি করেছে। তবে এসব গ্রামের সব পরিবার এখনো মাটির দালানেই বসবাস করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন