শিক্ষা অর্জনে শিশু-কিশোরদের কোন আনন্দ নেই। শিক্ষাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্লাস-কোচিং-প্রাইভেট, একের পর এক পরীক্ষায় যেন তাদের নাভিশ্বাস উঠে। মুখস্থ করো, পাস করো, সনদ নাও এটিই এখন শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন কারাগার আর কোচিং সেন্টারগুলো কনডেম সেলে পরিণত হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। এর থেকে বের হয়ে আসার জন্য মুখস্থ নয়, আনন্দপূর্ণ শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। গতকাল শনিবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সভাকক্ষে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা নিয়ে আয়োজিত কর্মশালায় তারা এসব কথা বলেন।
কর্মশালয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির অন্যতম সদস্য প্রফেসর জাফর ইকবাল বলেন, আগে কোচিং নামে কোন জিনিস ছিল না। এখন কোচিং-প্রাইভেট পড়তে হয়। জিপিএ-৫ না পেলে অপমান করা হয়, এটাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না? শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন করা হয়েছে যে, শিশু-কিশোরদের জীবন বলে কিছু নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট এই করতে হয় তাদের। ওদের জীবন বলে কিছু নেই। বাচ্চাদের জীবনকে আনন্দময় করতে হবে।
এনসিটিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভর পড়াশুনা থেকে বের করে বুঝে পড়ার ধারা চালু করার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার আগে ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক স্তরে পাইলটিং করা হবে। এজন্য ইতোমধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির চার মাসের পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক সহায়িকা ও অনুশীলন বই প্রণয়ন, ৬২টি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের, সংশ্লিষ্ট উপজেলার একাডেমিক সুপারভাইজারগণের এবং ৬৮২ জন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষককে ৫দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
নতুন কারিকুলামের বিষয়ে জাফর ইকবাল বলেন, আমরা নতুন পদ্ধতি হুট করে চালু করতে চাই না। এজন্য পাইলটিং করা হচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সেখানে দেখা হবে বাচ্চারা কতটা পারছে, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা? তথ্য বইয়ে থাকবে, কেন মুখস্থ করবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ইংরেজি দক্ষতার বিষয়। বলা, শুনা, লেখা ও পড়ার দক্ষতা থাকতে হয়। এতোদিন শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করতো। নতুন কারিকুলামে গাইড বই থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে শিক্ষকদের ওপর। তারা যদি চায় তাহলে সম্ভব।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আনন্দের সাথে পাঠদান দিতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে যেন তাদের নাভিশ্বাস না ওঠে। তারা যেন নিজেদের মত, চিন্তা প্রয়োগ করতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এটা যেদিন নিশ্চিত করতে পারবো সেদিন শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে পড়াশুনা কোন বোঝা নয়, এবং তারা যা পড়তে চায় তারা নিজেরা ঠিক করতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন প্রফেসর নিসার হোসেন বলেন, লেখাপড়া এখন শিশুশ্রমে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর রীতিমত অত্যাচার করা হচ্ছে। মাথার মধ্যে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবুল মোমেন বলেন, শহরের শিক্ষার্থীদের বাসাগুলো একেকটি খাচা, স্কুলগুলো জেলাখানা আর কোচিং সেন্টারগুলো কনডেম সেল। তাদের জন্য অন্যরা প্রশ্ন-উত্তর তৈরি করছে আর তারা মুখস্থ করছে। এর মাধ্যমে তারা কেবল আংশিকই শিখছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর মশিউজ্জামান বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের যে স্কুলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হবে- এ ধরনের ১১৫টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবির আওতায় সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এজন্য কিছু শিক্ষককে তৈরি করা হবে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে। তারা অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ না হলে এনসিটিবি কার্যক্রম বাস্তবায়ন হতে দেবে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েই এটি বাস্তবায়ন হবে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, শুধু কারিকুলাম পরিবর্তন করলে হবে না। সেটি বাস্তবায়নে সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। নতুন কারিকুলামে গ্রামের শিশুদের সঙ্গে শহরের শিশুদের বৈষম্য না থাকে সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বর্তমানে করোনা সংক্রমণ কমে আসছে। আশা করি ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে আমরা মাধ্যমিকের নতুন কারিকুলামে পাইলটিং ক্লাস শুরু করবো। এ বিষয়ে শিক্ষকদের ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, শিশু-কিশোরদের পড়ালেখা আনন্দময় করে তুলতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে পড়ার চাপ, মানসিক চাপ কমে যাবে, যা ব্যক্তি জীবনে কাজে আসবে।
নতুন কারিকুলামে প্রথম দিকে নানা ভুলভ্রান্তি উঠে আসতে পারে উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, শুরুতে আমাদের নানা ধরনের ভুল উঠে আসতে পারে। পাইলটিং শেষ করার আগে সেসব সংশোধন করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে সবার ক্ষেত্রে সুযোগ নিশ্চিত করা সরকারের মূল লক্ষ্য বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন