বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

কুষ্টিয়া হাইস্কুলের শতকোটি টাকার সম্পদ লুটপাট

দুদকের মামলায় আসামি প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রী

কুষ্টিয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৩:১৪ পিএম

শহরের ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়া হইাস্কুলের শতকোটি টাকার সম্পদ লুট করে তা অবৈধ ভাবে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান। প্রধান শিক্ষকের সীমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির কারনে এক সময়ের নাম করা প্রতিষ্ঠানটি এখন বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘটনায় দুদক মামলা করেছে খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি দশা থেকে উদ্ধারের করে লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি সচেতন মহলের।

একটা সময় কুষ্টিয়া শহরের সব থেকে খোলা মেলা ও দৃষ্টিনন্দন স্কুল ছিলো কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুল। পরে যার নামকরন হয় কুষ্টিয়া হাইস্কুল নামে। এ স্কুলেই লেখাপড়া করেছিলেন সাহিত্যেক মীর মশাররফ হোসেন, জাস্টিস রাধা বিনোদ পাল, শিক্ষাবীদ কাজী মোতাহার হোসেনসহ প্রতিথযশা অনেকে।

কালের পরিক্রমায় ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেড়শ বছরেরও বেশি পুরানো নামকরা এ স্কুলটিই এখন শহরের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আর স্কুল পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্যের লালসার শিকার স্কুলটি এখন ঢেকে গেছে বড় বড় মার্কেট আর দোকানে। এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা নেই। চারিপাশে মার্কেটের বড় বড় মার্কেটে ঢাকা পড়েছে স্কুলের মুল ফটকটি। সড়ক থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে একটি স্কুল রয়েছে। স্কুলের শতকোটি টাকার সম্পদ প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানসহ কয়েকজনের কপাল খুলে দিয়েছে। বাণিজ্যে কেন্দ্রে পরিণত হরে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। দোকান বরাদ্দ থেকে শুরু করে নির্মাণ কাজ সব খানে অনিয়ম আর অনিয়ম।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মজমপুর গেট থেকে পুর্ব দিকে কিছুদুর গিয়ে স্কুলটির অবস্থান। শহরের মুল যে বাণিজ্যেক কার্যক্রম হয় এনএস রোড ঘীরে, সেই সড়কের পাশে স্কুলটির চৌহদ্দীর অবস্থান। স্কুলের জায়গায় সব মিলিয়ে দোকান রয়েছে ৬ শতাধিক। বর্তমান প্রধান শিক্ষক যোগদানের পর একাই নির্মান করেছেন তিন শতাধিক দোকান। যা বরাদ্দ দিয়ে গোপনে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এমনকি পুকুর ভরাট ও যে খেলার মাঠে বঙ্গবন্ধু ভাষন দিয়েছিলেন সেখানেও দোকান নির্মান করে আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন। আর অবৈধ মেলার কারনে মাঠটি এখন ক্ষত-বিক্ষত। এতে দলীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ ক্ষুব্ধ।

স্থানীয় বাসিন্দা আনসার আলী বলেন, ‘স্কুলের মাঠে প্রতি বছর মেলা হয়। শহরের মধ্যে এই মাঠটি ছাড়া খেলার কোন জায়গা নেই। প্রধান শিক্ষক সুবিধা নিয়ে মাঠে মেলা করতে দেন। এছাড়া মাঠে দোকান নির্মাণ করায় ছোট হয়ে আসছে এর আয়তন। এ ছাড়া পুর্বপাশে ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, ছাত্রজীবনে বহু মিছিল সমাবেশ করেছি আমরা এই মাঠে। বঙ্গবন্ধু এ মাঠে এসে সমাবেশ করেছিলেন। সেই মাঠটি প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান শেষ করে দিলেন। মাঠে তিনি দোকান নির্মাণ করেছেন। একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল এখন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। তীলে তীলে স্কুলকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এটার একটা বিহিদ হওয়া প্রয়োজন।

১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়া হাইস্কুল। পুরাতন ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাথা উচু করে। পুরাতন ভবনের পেছনে একটি পুকুর রয়েছে। তবে সেটির বড় একটি অংশ ভরাট করে স্কুল ভবন ও মার্কেট করা হয়েছে। হাইস্কুলের যে সম্পদ রয়েছে তার মুল্য কোটি কোটি টাকা। এ সম্পদের ওপর চোখ অনেকের। এ সম্পদকে অর্থ আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রধান শিক্ষকসহ পরিচালনা কমিটি।



খলিলুর রহমান ২০১০ সালে ঘুষ দিয়ে হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে চাকুরি নেন। তার আগে বাগুলাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একই পদে চাকুরি করতেন তিনি। যোগদানের সময় খলিলুর রহমানের অর্থকড়ি তেমন না থাকলেও এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। আর এসবই হয়েছে মার্কেটের গুনে। তার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে মার্কেট জাদুর বলে। স্কুলের সর্বশেষ পরিচালনা পর্ষদের কমিটি গঠন করা হয় ২০১০ সালে। ডা. একেএম মুনির সেই কমিটির সভাপতি। মামলা জটিলতায় এরপর আর নতুন কমিটি হয়নি। দুইজন সদস্য ইতোমধ্যে মারা গেছে। ওই কমিটির নেতারায় প্রধান শিক্ষকের যোগসাজসে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন স্কুলে।

সম্প্রতি স্কুলের মার্কেট অনিয়ম, দোকান বরাদ্দ ও পজিশন বিক্রির বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে অনিয়মের ভয়াভহ চিত্র উঠে আসে। কোন তথ্য নেই স্কুলে। ভুয়া কাগজপত্র করে সব কিছু করেছেন প্রধান শিক্ষক। ইচ্ছামত দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন অর্থের বিনিময়ে।

কুষ্টিয়া হাইস্কুলে মার্কেটের তিনটি ভাগ রয়েছে। সব চেয়ে বড় মার্কেটটির নাম তমিজ উদ্দিন মার্কেট, আশরাফুল হক সুপার মার্কেট, আব্দুল ওয়াহেদ সুপার মার্কেট। এ ছাড়া খেলার মাঠের পশ্চিম অংশে নতুন একটি অংশ রয়েছে। সেখানেও বেশ কিছু দোকান রয়েছে।

এর মধ্যে তমিজ উদ্দিন মার্কেটটি সম্প্রতি নতুন করে বর্ধিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬ শতাধিক দোকান আছে তিনটি ইউনিটে। এর মধ্যে তমিজ উদ্দিন মার্কেটেই আছে তিন শতাধিক ছোট বড় দোকান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দোকান মালিক বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান স্কুলের ৮ থেকে ১০টির বেশি বড় জায়গা পজিশন আকারে বিক্রি করে দিয়েছেন। কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে রোকেয়া স্টোর, নুর টেইলার্স ও পাঞ্জাবী বাড়ীর ছাড়াও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে স্কুলের সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। স্কুলের এ জায়গা বিক্রি হয়েছে কয়েক কোটি টাকায়। এর মধ্যে পাঞ্জাবি বাড়ি কিনেছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা আর নুর টেইলার্স প্রায় দেড় কোটি টাকার ওপরে অর্থ দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গা কিনেছেন। এ টাকার বাইরে প্রধান শিক্ষক আরও অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন।

প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান আতার নিচ তলায় ৪টি ও ওপরে ৮টি দোকান রয়েছে। তিনি স্কুলের কাছ থেকে এগুলো নিয়েছেন।

এদিকে স্কুলের সম্পদ লুটে কোটি কোটি টাকা নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ করায় মামলা করেছে দুদক। যেখানে অন্য শিক্ষকরা ঠিক মত সংসার চালাতে পারেন না, সেখানে খলিলুর চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে, স্কুলের জায়গায় ফ্লাট করে থাকেন। সব কক্ষে তার এসি লাগানো রয়েছে। শহরে ফ্লাটসহ ব্যাংকে অবৈধ টাকা রয়েছে তার। শহরের বাইপাস সড়কের পাশে কয়েক একর জমির ওপর স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এসব ঘটনায় দুদক মামলা করেছে খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী বিলকিস রহমানের নামে।

মাঠের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রশাসন চাইলে না করতে পারি না। এসপির সহধর্মিনী পুনাকের সভানেত্রী। তারা মৌখিক ভাবে মাঠ চেয়ে মেলার জন্য কাজ করছে। এর আগে মাঠ ঠিক করতে অনেক অর্থ লেগেছে। জেলা প্রশাসন অনুমতি না দিলে মেলা করতে দেওয়া হবে না মাঠে।

জেলা শিক্ষা অফিসার জাহেদুর রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী মার্কেট নির্মাণ করার কোন বিধান নেই। বিষয়গুলো তাদের নজরে এসেছে। এ ছাড়া খলিলুর রহমানের নামে দুর্নীতির মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছিলো। সেভাবে আমরা তার সম্পদের তথ্য পাঠিয়েছি।

দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ জাকারিয়ার সাথে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, মামলার পর সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। চলমান রয়েছে আমাদের কাজ। বাকি বিষয়টি কমিশন দেখবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন