বাংলাদেশে ক্রমেই সড়ক ও মহাসড়কে যোগাযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক ও জেলাসড়কের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিসহ নতুন নতুন সড়ক নির্মিত হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষের পথে। পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার প্রক্রিয়ার সাথে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনও বেড়ে চলেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে সড়ক-মহাসড়কের এই বিস্তৃতি মানুষের নিরাপত্তার দিকটিকে নাজুক করে তুলেছে। দুর্ঘটনা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। মহাসড়ক নিরাপদ রাখার জন্য যে হাইওয়ে পুলিশ রয়েছে, পর্যাপ্ত লোকবল ও যানবাহনের অভাবে এসব সমস্যা নিরসন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ‘নিরাপদ সড়ক আমাদের অঙ্গীকার’-এই শ্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১১ জুন ৭২টি পুলিশ ফাঁড়ি নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরু হলেও বিগত দশ বছরে এর লোকবল, যানবাহন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি বাড়েনি। যে অবস্থায় গঠিত হয়েছে, তার থেকে খুব একটা উন্নতি হয়নি। এর ফলে হাইওয়ে পুলিশ একপ্রকার থাকা না থাকার মতো অবস্থায় রয়েছে। এতে হাইওয়েতে অপরাধ ও দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে। সড়ক-মহাসড়ক অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন এবং মানুষের নিরাপত্তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম শুরুর আগে ও পরে এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ না করার প্রবণতা রয়েছে। এজন্য প্রায়ই কোনো বড় ধরনের প্রকল্প শুরুর সময় এ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ হতে দেখা যায়। দেশের অগ্রযাত্রার জন্য সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়ন, সংস্কার ও সম্প্রসারণ একটি অপরিহার্য কর্মযজ্ঞ। তবে সড়ক-মহাসড়ক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি যে নিশ্চিত করা দরকার এ দিকটি বিবেচনা করা হচ্ছে না। নিরাপত্তা বিধানে যে হাইওয়ে পুলিশ রয়েছে, তার পরিধি বৃদ্ধি করারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাস্তবে আমরা এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মনোযোগ দিতে দেখছি না। এক হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে ৩ হাজার ৫৪৪.০৬ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪ হাজার ২৭৮.০৭ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ২৪৭.৭৯ কিলোমিটার। মোট সড়কের দৈর্ঘ্য ২০ হাজার ৯৪৭.৭৩ কিলোমিটার। এর বাইরে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অথচ বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়কের মধ্যে ১০ হাজার কিলোমিটার সড়কের নিরাপত্তা বিধানে হাইওয়ে পুলিশ সংখ্যা রয়েছে মাত্র দুই হাজার ৮২০ জন। চার জেলায় ২৮টি থানা ও ৪৪টি ফাঁড়ির অধীনে তারা কর্তব্যরত। এই অপর্যাপ্ত জনবলের পাশাপাশি হাতে গোনা কয়েকটি রেকার থাকলেও নেই কোনো অ্যাম্বুলেন্স। ফলে দুর্ঘটনার পর আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে না পারায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাপাশি মহাসড়কে প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অতি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মহাসড়কের দুই পাশে হাইওয়ে পুলিশের কর্মসীমা মাত্র দশ ফুট। এর বাইরে ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ ঘটলে অপরাধীদের গ্রেফতার, মামলা গ্রহণ ও তদন্তের এখতিয়ার ঐ এলাকার হাইওয়ে পুলিশের নেই। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করে নির্বিঘেœ পাশের গ্রাম বা এলাকায় চলে যায়। এছাড়া কোনো কোনো থানা ও ফাঁড়ির মধ্যকার দূরত্ব ৮০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার। টহল গাড়ি রয়েছে একটি। এর ফলে থানার আওতাধীন সড়কের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। উন্নত বিশ্বের কোথাও থানা ও ফাঁড়ির এমন দূরত্ব দেখা যায় না। সেখানে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে থানা বা ফাঁড়ি থাকে। প্রতিটি থানা ও ফাঁড়িতে টহল গাড়ি থাকে ৮ থেকে ১০টি এবং সমসংখ্যক রেকার ও অ্যাম্বুলেন্স থাকে। দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটলে মুহূর্তে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের হাইওয়ে পুলিশ যে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু উন্নত বিশ্বের তুলনায় নয়, বিদ্যমান সড়ক ও মহাসড়কের বিস্তৃতির তুলনায়ও তা নস্যি। ফলে সড়ক-মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের কোনো অস্তিত্ব ও উপস্থিতি আছে কিনা, তা মানুষ বুঝতে পারে না। তার উপর এ বাহিনীর ক্ষমতা, সক্ষমতা ও কর্মপরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায়, তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ন্যূনতম সেবাও পাওয়া যাচ্ছে না।
সড়ক-মহাসড়ক বিস্তৃত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এ বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সমানুপাতে হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা, কর্মপরিধি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরী। এটা এখন প্রামাণিত, বিদ্যমান হাইওয়ে পুলিশ সড়ক-মহাসড়কের জন্য খুব একটা কার্যকর নয়। এ কথা ভাবতে হবে, অপ্রতুল এই হাইওয়ে পুলিশ দিয়ে যদি কার্যকর কোনো সুফল না পাওয়া যায়, তবে তা সরকারের অর্থ অপচয়ের শামিল। এটা অনেকটা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কোনো হাইওয়ে পুলিশ চলতে পারে না। হাইওয়ে পুলিশের প্রয়োজন রয়েছে। এ পুলিশকে আধুনিক করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এজন্য লোকবল, থানা ও ফাঁড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত যানবাহন, সরঞ্জাম এবং তার ক্ষমতা ও কর্মপরিধি বৃদ্ধিসহ যা যা করা প্রয়োজন তাই করতে হবে। দেশের বিশাল সড়ক নেটওয়ার্কে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন