বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

নান্দনিক লিটন, ১৩ হাজারি মুশফিক

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:২০ এএম

প্রথম ওয়ানডেতে শুরুতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ দল। এক ফজলহক ফারুকির আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের টপ অর্ডার। বাঁহাতি আফগান পেসারের বলে নিজেও ফিরেছিলেন মাত্র এক রানে। সেই ম্যাচের অসম্ভব এক জয়ে নায়ক ছিলেন সপ্তম উইকেটের দুই নবীন- আফিফ হোসেন আর মেহেদী হাসান মিরাজ। অনুজদের সেই নিবেদন থেকে শিক্ষা নিয়েই কি-না, একদিনেই ভোজভাজির মত পাল্টে গেলেন বাংলাদেশ। দাপুটে জয়েই সফরকারীদের জানিয়ে দিল, ‘এই ফরম্যাটে আমরা টাইগার-ই’।
এই আমূলে পাল্টে যাওয়ার সবচাইতে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ধরা দিলেন লিটন কুমার দাস আর মুশফিকুর রহিম। কোনো ঝুঁকি নিয়ে না খেললে এমন উইকেটে রান করা কঠিন নয়। ব্যাট হাতে আলো ছড়ান ওপেনার লিটন, তুলে নেন ৫ম সেঞ্চুরি। অভিজ্ঞ মুশফিকের ব্যাট থেকেও ঝরে হাসি, তিন অঙ্কের খুব কাছ থেকে ফেরা এই উইকেট কিপার ব্যাটার মাইলফলক ছুঁয়েছেন ১৩ হাজারি ক্লাবের। তাতে পুরো ৫০ ওভার খেলে স্বাগতিকরা তোলে ৪ উইকেটে ৩০৬ রান। এই সংস্করণে আফগানদের বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দলীয় স্কোর। যেটি পেরিয়ে যেতে পারেনি আফগান শিবির। ২১৮ রানে থামলে ৮৮ রানের জয়ে এক ম্যাচ আগেই সিরিজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ।
তবে এদিন জয় ছাপিয়ে ম্যাচের সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন লিটন। সংখ্যা বলছে, ১২৬ বলে ১৩৬ রানের ইনিংস। ১৬ চারের সঙ্গে ছক্কা দুটি। বেশ সমীহ জাগানিয়া অঙ্ক। তবে এসবই সবটুকু নয়। সবটুকু নয় তার নান্দনিকতা ও স্ট্রোকের ছটাও। বরাবরের মতোই চোখ আর মনে প্রশান্তির পরশ ছড়িয়ে দেওয়া কিছু শট, কবজির রেশমি পেলব বুলিয়ে দেওয়া স্ট্রোক এসব তো ছিলই। তবে গতকাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামে তার এই সেঞ্চুরির ওজন অনেক বেশি মূলত তার ইনিংস গড়ার ধরনে।
এই ইনিংসে স্রেফ শৌর্য ছিল না, প্রতিভার জানান দেওয়ার স্পর্ধা ছিল না, প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা ছিল না। বরং ছিল নিজের সঙ্গে লড়াই করা, পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করা, প্রয়োজনের সময় প্রতিপক্ষের প্রতি সমীহ আর সময়মতো জ্বলে ওঠা। তার স্কিলের বিজ্ঞাপন মেলে ধরা দারুণ পরিণত এক ইনিংস।
ইনিংসের শুরুটায় তিনি খুব স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না। আগের ম্যাচে আউট হন ১ রানে। এই ম্যাচেও আফগান বাঁহাতি পেসার কিছুটা পরীক্ষা নেন তার। নতুন বলে কয়েকবার পরাস্ত হন তিনি অফ স্টাম্পের বাইরে। কয়েকবার বল লাগে ব্যাটের কানায়। অনেকবারই এরকম সময়ে ছটফট করে তিনি উইকেট বিলিয়ে এসেছেন। এ দিন সেটির ব্যতিক্রম। তাড়াহুড়ো না করে তিনি আগলে রাখেন উইকেট। এক-দুই রানে মন দেন। নিজেকে সময় দেন। ১০ ওভার শেষে তার রান ছিল ২৩ বলে ১৯।
আরেক প্রান্তে ওপেনিং জুটির সঙ্গী তামিম ইকবালের পর আউট হয়ে যান সাকিব আল হাসানও। লিটন আরও সাবধানী হয়ে ওঠেন। ইনিংসের ২০ ওভার শেষে তার রান ৪৬ বলে ৩৫। মুশফিকের সঙ্গে তার জুটি জমে উঠতে থাকে। তিনিও ক্রমে নিজের শটের ভাণ্ডার মেলে ধরতে শুরু করেন। রহমত শাহর এক ওভারে দুটি বাউন্ডারিতে পঞ্চাশের কাছাকাছি যান। মোহাম্মদ নবির বলে চার মেরে ফিফটিতে পৌঁছান ৬৫ বলে, ইনিংসের ২৫তম ওভারে। বল প্রতি রান নিয়ে এগোতে থাকেন। রশিদ খানের স্কিলের জবাব দেন স্কিল দিয়েই, মুজিব উর রহমানের রহস্য তার সামনে মনে হয় খোলাসা, মোহাম্মদ নবির অভিজ্ঞতাকে তিনি মাড়িয়ে যান অনায়াসে। ফিফটি থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে বল খেলেন ৪২টি।
তাতে একটি প্রথমের জন্মও হয়ে যায়। পঞ্চাশের কম ইনিংস খেলেও যে ওয়ানডেতে ৫ সেঞ্চুরি করে ফেলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেট এটা দেখল প্রথমবার। ৪৯ ইনিংসেই এলো তার পঞ্চম সেঞ্চুরি। একশর কম ইনিংস খেলে ৫ সেঞ্চুরিই আগে কেবল ছিল সাকিবের (৯৩ ইনিংস)। বাংলাদেশের হয়ে রেকর্ড ১৪টি সেঞ্চুরি করা তামিম ৫ সেঞ্চুরি করতে খেলেছিলেন ১৪১ ইনিংস। মুশফিক পঞ্চম সেঞ্চুরির দেখা পান ১৬৩তম ইনিংসে। বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যানের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নেই ৫ সেঞ্চুরি।
রেকর্ড বইয়ে নাম উঠে গেলেও ম্যাচ পরিস্থিতির চাওয়া ছিল আরও কিছু। লিটন সেই দাবিও মেটান। সেঞ্চুরির পর আরও দ্রুতগতিতে রান তুলতে থাকেন। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তার জুটি স্পর্শ করে দুইশ। পেছনে পড়ে যায় ২০১৫ সালে গড়া তৃতীয় উইকেটে তামিম ও মুশফিকের ১৭৮ রানের রেকর্ড। তার ড্রাইভ, ফ্লিক, গ্ল্যান্স তো বরাবরই নান্দনিক। এ দিন তার লেট কাটও ছিল চোখে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। মুজিব-রশিদের মতো বিশ্বমানের স্পিনারদেরও হতাশ করেন তিনি দারুণ সব কাট শটে।
সেঞ্চুরির পর ফারুকির বলে পরপর লিটনের দুটি শটকে বলা যায় তার প্রতিভা আর সামর্থ্যরে উজ্জ্বল নজির। তাকে ক্রিজ ছেড়ে বেরোতে দেখে বেশ বাইরে ফুল লেংথ বল করেন আফগান বাঁহাতি পেসার। লিটন বল বুঝে তাৎক্ষনিক মানিয়ে নিয়ে হাঁটুগেড়ে চালিয়ে দেন বল। পয়েন্ট দিয়ে গুলির বেগে সীমানায়। পরের বলটি তিনি যেন জানতেন যে শর্ট বা শর্ট অব লেংথ হবে। বোলার সেটিই করেন। লিটন দ্রুত পজিশনে গিয়ে সপাটে পুল করেন। বল আছড়ে পড়ে গ্যালারির দ্বিতীয় তলার দেয়ালে।
ফারুকির পরের ওভারে আরেকটি ছক্কা মারেন তিনি কবজির জোরে। শেষ পর্যন্ত ইনিংসটি শেষ হয় বাঁহাতি পেসার ফরিদ আহমাদ ফারুকির সেøায়ার শর্ট বলে স্কয়ার লেগে ধরা পড়ে। প্রথম ৩৩ ওয়ানডে ইনিংসে একটি কেবল সেঞ্চুরি ছিল তার। সবশেষ ১৬ ইনিংসে ৪টি সেঞ্চুরি হয়ে গেল। ৫ সেঞ্চুরির সঙ্গে তার ফিফটি কেবল ৩টি। ফিফটিকে শতরানে রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব যেমন বোঝা যাচ্ছে এতে, তেমনি অনেকবার দ্রুত আউট হওয়ার চিত্রও ফুটে উঠছে। ৪৯ ওয়ানডে ইনিংসে ২০ বারই আউট হয়েছেন তিনি দুঅঙ্ক ছোঁয়ার আগে!
এদিন লিটন ১৬ চার ও ২ ছক্কা। লিটনের পরের বলেই সাজঘরের পথ ধরেন মুশফিক। র‌্যাম্প শট খেলার চেষ্টায় থার্ড ম্যানে ধরা পড়েন ফারুকির হাতে। আফগানদের এলোমেলো বোলিংয়ের সুবিধাটা তিনিও পেয়েছেন ইনিংসের শুরুতে। তবে ৪১তম ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে ব্যর্থ ৮৬ রানের ইনিংসটি মুশফিক সাজিয়েছেন প্রান্ত বদল করার দুর্দান্ত দক্ষতায়। ৯৩ বলে চার মেরেছেন মাত্র ৯টি! সঙ্গে ১৮৬ বলে ২০২ রান যোগ করা মুশফিক ছিলেন দুর্দান্ত ছন্দে। ওয়ানডেতে তৃতীয় উইকেটে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি।
মুশফিকের আক্ষেপ কিছুটা কমতে পারে আরেকটি পরিসংখ্যানে। সেঞ্চুরি না পেলেও এই ইনিংস খেলার পথে সব ফরম্যাট মিলিয়ে এই ডানহাতির রানসংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়ায়। বাংলাদেশের জার্সিতে মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১৩ হাজারি ক্লাবের অনন্য উচ্চতায় পা রাখলেন ৩৪ বছর বয়সী এই ডান হাতি উইকেট কিপার ব্যাটার। অবধারিতভাবে তালিকার শীর্ষে আছেন তামিম। ৩৫৯ ম্যাচে ১৪ হাজার ১৭৫ রান করেছেন ওয়ানডে দলপতি। এই মাইলফলকে পৌঁছাতে মুশফিককে খেলতে হয়েছে ৪০৬ ম্যাচ। ৩৭০ ম্যাচে ১২ হাজার ৫৫৩ রান নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছেন সাকিব আল হাসান।
৪৬ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ২ উইকেটে ২৮৪ রান। অর্থাৎ স্কোরবোর্ডে ৩২০ বা এর চেয়েও বেশি রান জমা করার জোরালো সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। শেষ ৪ ওভারে টাইগাররা তোলে মোটে ২২ রান। লিটন ও মুশফিকের বিদায়ের পর থাকেনি দ্রুত গতিতে রান তোলার ধারাবাহিকতা। মাহমুদউল্লাহ ৯ বলে ৬ ও আফিফ হোসেন ১২ বলে ১৩ রানে অপরাজিত থাকেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন