করোনার কারণে দ্বিতীয় দফা বন্ধের পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়েছে। এই সময়ে ক্লাসের বাইরে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার থেকে শুরু হলো তাদেরও ক্লাস। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে মুখরিত। ক্লাসে ফিরতে পেলে শিক্ষার্থীরাও উল্লসিত। কলেজ জীবনের প্রথম দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের বরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় ফুল, কলম, বই। কোথাওবা গান গেয়ে বরণ করা হয় তাদের, সভা-সেমিনারে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরাও প্রথম দিনটি কাটিয়েছেন সহপাঠি-শিক্ষকদের সাথে পরিচয়, আড্ডা ও কলেজ দর্শনেই। রাজধানীর ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণির ক্লাস উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই তুলে দেন। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে আগুনের পরশমনি গান গেয়ে এবং ফুল দিয়ে নবীনদের বরণ করে নেয়া হয়। পাশাপাশি মাস্ক ও স্যানিটাইজারও তুলে দেয়া হয় তাদের হাতে। আজিজুল হক কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ বলেন, কলেজে এসে বেশ ভালো লাগছে, আমি চাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক আগের মতো সব ঠিক হয়ে যাক।
অন্যদিকে ঘরবন্দি থেকে মুক্তি পেয়ে যেন আনন্দের সীমা নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ১ মাস ৯ দিন পর ক্লাস রুমে ফিরতে পেরেই স্বস্তি তাদের। করোনার কারণে দ্বিতীয় দফা বন্ধের পর গতকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সকল শিক্ষার্থীর জন্যই খুলে দেয়া হয়। এদিন রাজধানীসহ সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ছিল শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে মুখরিত।
একাদশ শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন। এর আগে সকালে ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেনির নতুন শিক্ষার্থীদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই তুলে দেন। এ বইয়ের ওপর পরে আবার কুইজও অনুষ্ঠিত হবে।
শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের মায়ের মত মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকেও ভালোবাসার আহবান জানিয়ে বলেন, গত প্রায় দু›বছরে করোনা অতিমারির মধ্যে আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। এরমধ্যেও আমরা পুনর্বিন্যাস করা সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশ করেছি। কলেজে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি।
প্রাথমিকে ক্লাস শুরু: করোনার কারণে দ্বিতীয় দফায় প্রায় ছয় সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর প্রতিদিন ক্লাসের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত ক্লাসের মাধ্যমে তারা মহামারীর দুই বছরের শিখন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ছিলে চোখে পড়ার মতো। সকাল সকাল আড়-মোড় ভেঙে ঘুম ঘুম চোখে ক্লাসে ফিরেও যেনো চোখে-মুখে ছিল উৎসবের আভা। তবে প্রথম দিনে উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম। ধীরে ধীরে উপস্থিতি বাড়বে বলে আশা করছেন শিক্ষকরা। আবার অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে সব ক্লাস শুরু হবে।
রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে দেখা গেছে, সকালে ক্লাস শুরুর আগে মাঠে খেলায় মেতেছে শিশুরা। দীর্ঘ বিরতির পর বন্ধুদের কাছে পেয়ে তারা উল্লসিত। ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির সুরভীর বললো, ক্লাস করতে না পেরে খারাপ লাগছিল। কবে ক্লাসে আসব সেজন্য অপেক্ষা করছিলাম। তার মা সুরমা বেগম বলেন, স্মার্টফোন নেই, মেয়ে ক্লাস করবে কীভাবে? গতবছর কিছুটা পিছিয়ে গেছে। অনলাইনে অন্যরা প্রতিদিন ক্লাস করেছে। সেখানে নিজে নিজে পড়ে সে কুলাতে পারে নাই। এখন তো প্রতিদিন পড়তে পারবে।
মিরপুরের মনিপুর স্কুলের অভিভাবক রশিদা আক্তার বলেন, বন্ধের সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে কিন্তু অনলাইনের পড়া তো আর ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না। আর ছোট বাচ্চারা তো আরও বুঝতে পারে না। এখন শিক্ষকরা নজর দিলে গ্যাপটা কমতে পারে।
পল্লবীর ক্যাপিটাল মডেল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী শহীদুল ইসলাম জানাল, বুধবার তাদের পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে। সবার সাথে দেখা হওয়ায় খুব খুশি সে।
পল্লবীর এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসাইন বলেন, বাচ্চাদের অনেক আগ্রহ স্কুলে আসতে। অনলাইনে তো সেভাবে তারা আনন্দ পায় না। প্রতিদিন স্কুলে আসায় পড়ালেখাটাও নিয়মিত হবে। মিরপুর-১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরে আলম জানান, আগের রুটিনে ক্লাস হবে ভেবে কিছু শিক্ষার্থী আসেনি। তাই প্রথম দিন উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। আমরা তাদের জানিয়েছি, কয়েকদিনেই এটা ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চারা তো উদগ্রীব হয়ে আছে প্রতিদিন ক্লাসে আসতে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রাথমিকের ক্লাস শুরু হল। আমাদের মাধ্যমিকেও শিগগিরই স্বাভাবিক জায়গায় চলে যাবার চেষ্টা করব। গত দুই বছর তাদের পড়াশোনায় অনেক বিঘ্ন ঘটেছে। অনেকে পারিবারিক-সামাজিক এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের যেখানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে নজর দেব বেশি। হয়ত এক শিক্ষাবর্ষে সব ঘাটতি পূরণ করতে পারব না। কিন্তু আমরা আশা করছি এই শিক্ষাবর্ষ এবং আগামী শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে যেখানে যতটুকু ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে পারব। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ঘাটতি কমাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে, তারা যে বিষয় পড়বে, সেখানে আগের ক্লাসের পড়ায় যদি ঘাটতি থাকে- সেটার প্রাথমিক একটা অ্যাসেসমেন্ট করে যদি ক্লাস করিয়ে নিতে পারে, তাহলে সেটা শিক্ষার্থীরা পুষিয়ে নিতে পারবে।
২০ মার্চ প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস: ২০ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস। গতকাল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মনীষ চাকমার সই করা প্রাথমিকের ক্লাস রুটিন থেকে এ তথ্য জানা যায়। ক্লাস রুটিনে বলা হয়, প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শ্রেণি কার্যক্রম কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ২০ মার্চ থেকে শিক্ষক সহায়িকায় প্রদত্ত রুটিনের আলোকে পরিচালিত হবে। ক্লাস রুটিনে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ ঘাটতি চিহ্নিত করে বিশেষ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন