শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

২৮ নাবিককে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর

জাহাজে রকেট হামলা ইউক্রেনে বাংলাদেশি নিহত : নেয়া হবে পোল্যান্ডে

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২২, ১২:০২ এএম

 

ইউক্রেনের বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধিতে রকেট হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ২৮ জীবিত নাবিককে উপকূলে বাংকারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারা নিরাপদে আছেন এবং খুব শিগগিরই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় বিএসসির নির্বাহী পরিচালক ড. পীযূষ দত্ত ইনকিলাবকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সময় ৬টার দিকে বাংলার সমৃদ্ধি থেকে ২৮ নাবিক নেমে গেছেন। তাদের একটি টাগবোট যোগে বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। সাথে রকেট হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পোলান্ড দূতাবাসের সহযোগিতায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে। বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায়) বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে রকেট হামলা হয়। হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পৌঁছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হয়ে যাওয়ায় ২৯ নাবিকসহ সেখানেই আটকা পড়ে জাহাজটি। ইউক্রেন থেকে সিরামিকের কাঁচামাল নিয়ে তাদের ইতালিতে যাওয়ার কথা ছিল। নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাদের স্বজনদের মাঝে কিছু টা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।

গত বুধবার রাতে রকেট হামলায় জাহাজটির তৃতীয় প্রকৌশলী হাদিসুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর অন্য নাবিকের স্বজনেরা তাদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে বিএসসি অফিসে ভিড় করেন। তবে বিএসসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটকেপড়া জাহাজের ২৮ নাবিকের জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পর্যায়ে ব্যাপক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার আগে জাহাজে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের নিকটবর্তী কোন বাংকারে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান বিএসসির কর্মকর্তারা।

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নোঙর করে রাখা জাহাজটিতে বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার দিকে) রকেট আঘাত হানে। এতে জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধে এ প্রথম কোন বাংলাদেশির মৃত্যু হলো। নিহত হাদিসুর রহমানের বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের পুত্র।

হাদিসুর চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পাস করার পর ২০১৮ সাল থেকে ওই জাহাজে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন ছয় মাস আগে। ইউক্রেনের ওই জাহাজে আটকেপড়ার পর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল তার। হামলার দিন বাড়িতে স্বজনদের সাথে মোবাইলে কথা বলেন তিনি। রাত ৯টা নাগাদ ছোট ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে জাহাজের কেবিন থেকে ব্রীজে উঠে যান তিনি। এ সময় রকেট হামলায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন হাদিসুর। তখন জাহাজটির এক অংশে আগুন ধরে যায়। জাহাজের নাবিকেরা দ্রুত সে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এতে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় জাহাজ ও নাবিকেরা। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বজনদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। একইসাথে জাহাজে আটকেপড়া আরও ২৮ নাবিকের পরিবারেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়।

বিএসসি সূত্রে জানা গেছে, নিহত নাবিকের লাশ জাহাজের হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সহকর্মীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন জাহাজের নাবিকেরা। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। সর্বশেষ গতকাল বিকেল নাগাদ জাহাজ থেকে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন কয়েকজন নাবিক। তারা বলেন, রকেট হামলায় জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেতার যোগাযোগও বিনষ্ট হয়ে গেছে। জেনারেটর দিয়ে কোনরকম আলোর ব্যবস্থা করা হলেও রান্না করার সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাদের শুকনো খাবার খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে তারা জাহাজ থেকে বাংকারে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তারা বলছেন, টাগবোটের ব্যবস্থা হলে তারা বাংকারে ফিরে যেতে পারবেন। যেকোন সময় আবারও রকেট হামলায় আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তারা।

এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এক নাবিককে বারবার বলতে শোনা যায়, আমাদের বাঁচান। আমাদের কোন জায়গা থেকে সাহায্য আসেনি। উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা দেওয়া এক বাংলাদেশি নাবিক নিজেকে জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেন। ২৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে বাংলাদেশি নাবিককে বলতে শোনা যায়, আমি বাংলার সমৃদ্ধির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের জাহাজে রকেট হামলা হয়েছে। একজন মারা গেছেন। পাওয়ার সাপ্লাই নেই। ইমার্জেন্সি জেনারেটরে পাওয়ার সাপ্লাই চলছে। আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি। আমাদের এখনো উদ্ধার করা হয়নি। দয়া করে আপনারা আমাদের বাঁচান। আমরা সবাই আছি এখানে, দেখেন। আমাদের কোনো জায়গা থেকে এখনো সাহায্য আসেনি।

জাহাজটির অপর এক নাবিক আরেকটি ভিডিও নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। তার নাম আসিফুল ইসলাম। ৩১ সেকেন্ডের এ ভিডিওতে তিনি বলেন, আমি আসিফুল ইসলাম আসিফ। আমরা নাকি পোল্যান্ডে চলে গেছি নিরাপদভাবে। এটা ভুল নিউজ। আমাদের প্লিজ এখান থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।

এদিকে জাহাজে রকেট হামলার পর গতকাল সকাল থেকে নাবিকদের স্বজনেরা নগরীর বন্দর এলাকায় অবস্থিত বিএসসির প্রধান কার্যালয়ে আসতে থাকেন। তারা যেকোন মূল্যে নাবিকদের উদ্ধারের আকুতি জানান কর্মকর্তাদের কাছে। জাহাজে আটকেপড়া নাবিক মাসুদ বিল্লাহর বাবা মো. ওবায়দুল হক বলেন, জাহাজে হামলার পরপর তার ছেলে মেসেজ পাঠিয়েছেন। তারা খুব আতঙ্কে আছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনুন। ওবায়দুল হকের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী এলাকায়। তিনি থাকেন নগরীর কাটগড়ে।

জাহাজটির ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমানের নিকটাত্মীয় আবদুল্লাহ আল মামুনও নাবিকদের উদ্ধারে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে চান বিএসসির কর্মকর্তাদের কাছে। তিনি জানান, মাসুদুর রহমানের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলায়। সেখানে তার বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান চরম উৎকণ্ঠায় আছেন।
বিএসসির পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দুপুরে কথা বলেন কর্মকর্তারা। বিএসসির নির্বাহী পরিচালক ড. পীযূষ দত্ত বলেন, আটকেপড়া নাবিকদের জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নাবিকদের জাহাজ থেকে বাইরে নিয়ে আসা বিপদজনক। নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই নাবিকদের সরিয়ে আনা হবে। এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরসহ সবাই কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখনো জাহাজই নিরাপদ। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি রয়েছে। যুদ্ধের ডামাডোলে জাহাজটি ইউক্রেন পাঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাহাজটি না পাঠানোর সুযোগ ছিল না। চার্টারার যদি যেতে চায় আইনগতভাবে না পাঠানোর সুযোগ নেই। ক্যাপ্টেনের পারফরম্যান্সে আমরা সন্তুষ্ট। তারা জীবনবাজি রেখে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন ক্ষয়ক্ষতি কমানোর।

অপরদিকে বিএসসির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নাবিকদের দাবি অনুযায়ী তাদের নিরাপদ কোন বাংকারে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রেডক্রস বা অন্য কোন সংস্থা জরুরি পরিবহনের মাধ্যমে জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হবে। তারপর তাদের নিরাপদ কোন বাংকারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের এ জাহাজটি তুরস্কের ইরাগলি বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে উদ্দেশে রওনা হয়। দুই দিন পর ওই বন্দরেরর নৌসীমায় নোঙর করে জাহাজটি। মালামাল বোঝাই করার আগেই শুরু হয় যুদ্ধ। বর্তমানে জাহাজটিতে ২৮ জন নাবিক রয়েছেন। তাদের দুইজন নারী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
মমতাজ আহমেদ ৪ মার্চ, ২০২২, ৫:০১ এএম says : 0
আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুক
Total Reply(0)
আবদুল মান্নান ৪ মার্চ, ২০২২, ৫:২৩ এএম says : 0
এই পদক্ষেপ গুলো আগে নিলে হয়ত হাদিসুর রহমানের প্রাণ টা বেঁচে যেত!
Total Reply(0)
মোঃ মাসুদুর রহমান ৪ মার্চ, ২০২২, ৫:২৩ এএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ।
Total Reply(0)
গিয়াস উদ্দিন ৪ মার্চ, ২০২২, ৫:২৫ এএম says : 0
ওখানে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশিকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক
Total Reply(0)
Md. Asaduzzaman ৪ মার্চ, ২০২২, ৫:২৫ এএম says : 0
বাংলাদেশ কখনোই কোনো কাজে গুরুত্ব দেয় না। আগে সতর্ক থাকলে প্রাণ যেত না ভাইটার।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন